শ্রীলঙ্কায় গৃহযুদ্ধের কারণে গার্মেন্ট সেক্টরে লগ্নি করা ফড়িয়া পুঁজি রাতারাতি শ্রীলঙ্কা থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে বাংলাদেশে ঘাঁটি গাড়ে আশির দশকে। সে সময় এই অ্যাসেমব্লিং ইণ্ডাষ্ট্রিকে কাঙালের চোদ্দ আনা মনে করে ধূপ-ধুনো দিয়ে পূজো করা হয়েছিল। রাতারাতি বড় রাস্তার পাশে ভাঙ্গাচোরা ভবনে জানলা-দরজা লাগিয়ে ‘ফ্যাক্টরি’ করা হয়েছিল। মাত্র কয়েক বছরেই সেই ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে ওঠা গার্মেণ্ট ইণ্ডাষ্ট্রি এদেশের অন্যতম বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের মাধ্যম হয়ে ওঠে। কলাগাছের মত বেড়ে ওঠে একটি লুম্পেন প্যারাসাইট শ্রেণি। তাদের দাপটে এরপর ঢাকা, নারায়নগঞ্জ, চট্টগ্রামে বিশেষায়ীত অঞ্চলে গার্মেন্ট শিল্প গড়ে ওঠে। ততদিনে স্টাবলিস্ট হয়ে গেছে যে আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে এই শিল্পই সবচেয়ে বেশি অবদান রাখছে। এবার আর তাকে পায় কে? গার্মেণ্ট মালিকরা কিছুদিনেই এদেশের দণ্ডমুণ্ডের কর্তার আসনে বসে পড়েন।
সরকারের প্রায় একতৃতীয়াংশ সদস্য কোনো না কোনোভাবে গার্মেণ্ট সেক্টরের সঙ্গে যুক্ত। বিরোধীদলেও আনুপাতিক হারে এই সেক্টরের লোকজন ছড়ি ঘোরান। অর্থনীতিতে ‘অবদান’ নিশ্চিত হবার পর মালিকরা সঙ্গত কারণেই কৃতিত্ব দাবী করেন। সরকারও দ্বিধাহীন তাদেরকে কৃতিত্ব প্রদান করেন। এবার তারা রাজনীতিকেই নিয়ন্ত্রণ শুরু করেন, এবং নিশ্চিতভাবেই সফল হন। প্রতি বছর নিয়ম করে আগুনে পুড়িয়ে স্টকলট ধ্বংস করার ভেতর শত শত হতভাগা শ্রমিককেও আত্মাহুতি দিতে হয়। নিয়ম করে জরাজীর্ণ ভবনগুলো এক সময় ভাঙ্গতে শুরু করে। ভবনের নিচে চাপা পড়ে প্রতি বছরই শ্রমিকদের করুণ মৃত্যু ঘটতে থাকে। আগুনে পোড়া, ভবনধ্বসে মৃত্যু, আগুন গুজবে সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে মৃত্যু, বেতন নিয়ে দেন-দরবারের সময় পিটিয়ে শ্রমিক হত্যা, নারী শ্রমিককে ধর্ষন করা, শিশু শ্রমিককে শোষণ করা, বয়ষ্ক শ্রমিককে দাসের মত ব্যবহার করা নিত্য নৈমিত্যিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে।
এই অমানবিক দাসযুগের ব্যবস্থা আর শ্রমিকদের প্রতি প্রভুসুলভ কর্তৃত্ব এমনকি সেই প্রাচীন দাসযুগকেও ম্লান করে দেয়। এরই মধ্যে সব চেয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনাটি ঘটে সাভারে। রানা প্লাজা নামক ওই ভবনে আসলে যেটি ঘটেছিল সেটি কোনো দুর্ঘটনা ছিলনা, ছিল তাচ্ছিল্যপূর্ণ হত্যাকাণ্ড। সেই হত্যাকাণ্ডে কেবলমাত্র গার্মেণ্ট মালিকরাই জড়িত ছিলনা, ছিল ভবনমালিক, ইউএনও, ইউপি চেয়ারম্যান, ইউপি সদস্য, ব্যাংক কর্তাসহ অন্যান্য বেশ কিছু স্টেক হোল্ডার। এই ঘটনার পর পরই বিদেশি ক্রেতার ‘রুষ্ঠ’ হয়ে ‘কমপ্লায়েন্স’ কারখানা নামক কুমিরছানা প্রদর্শনের ব্যবস্থা করে। তারা র্যান্ডম কারখানাগুলো তদারকি করে নিরাপত্তাসহ অন্যান্য বিষয়াদি পরীক্ষ-নিরীক্ষা করে ‘সেইফ’ সার্টিফিকেট দেয়। দেয় ‘কমপ্লায়েন্স’ সার্টিফিকেটও। এর পর মালিকগণ এই সার্টিফিকেট বাঁধাই করে নতুন ফর্মেটে নির্যাতন শুরু করে।
সারা দেশের সকল সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন বেড়ে দ্বিগুণ হলেও গার্মেণ্ট শ্রমিকের বেতন বাড়েনা। তাদের বেতনের কথা উঠলেই সারা দেশের সকল মহল শেয়ালের মত একসঙ্গে হুক্কহুয়া ডেকে শ্রমিকের বেতন বাড়লে কারখানা কিভাবে লোকসানে পড়বে সেই ‘মহাভারত’ বয়ান করেন। প্রায় সকল মিডিয়া নির্লজ্জের মত মালিকের পক্ষে গিয়ে শ্রমিকরে রক্ত শোষায় মদদ দেয়। বাংলাদেশের গার্মেন্ট শ্রমিকদের মত এমন হতভাগ্য শ্রমিক আর কেউ নেই। আর কোথাও নেই। সমাজের সঙ্গবদ্ধ একটি শেণিও শ্রমিকদের পক্ষে দাঁড়ায় না। না সরকার, না বিরোধিদল, নাম সুশীল সমাজ, না সচেতন জনসাধারণ, কেউ না। কেন? তারা কি ভিন গ্রহ থেকে এসেছে? নাকি অস্পৃশ্য? তারা কি এদেশের মাটিতে জন্ম নেন নি? তারা কি আমাদের কারো ভাই, কারো বোন, কারো সন্তান, কারো বাবা-মা নন? সম্ভবত নন। আর সে কারণেই শহুরে উঠতি ধনিক শেণি থেকে শুরু করে একেবারে সাধারণ মানুষও এই গার্মেন্ট শ্রমিকদের বিরুদ্ধে। এ এক অদ্ভুত বৈপরিত্য!
মালিকরা শ্রমিকদের রক্ত নিংড়ে নিয়ে দেশের সকল সুযোগ-সুবিধা আদায় করে, সকল ধরণের ইনসেন্টিভ নিয়ে, বিরাট বিরাট আর্থিক সহায়তা নিয়ে, ব্যাংকে গচ্ছিত জনসাধারণের টাকা মেরে, বিদেশি প্রভুদের সস্তা শ্রমের বাজার দেখিয়ে, সরকারের দালালি করে অনেকেই এখন এমপি হয়েছেন, মন্ত্রি হয়েছেন, মেয়র হয়েছেন। তারা এখন সরকারকে তাদের দাবী-দাওয়া মানতে ‘বাধ্য’ করতে পারেন। তাদের কথা ভেবেই সরকারকে পলিসি নির্ধারণ করতে হয়। দেশে-বিদেশে সুনাম কামিয়ে সেই মালিকদের অনেকেই তাদের শ্রমিকদের জীবন-যাপন উন্নত হয়েছে বলে গলা ফাটিয়ে লেকচার ঝাড়েন। সেসব লেকচার শুনে কি করা উচিৎ তা ভাবাই সার, কেননা কোনো সরকারই গার্মেন্ট মালিকদের চটায় না। কেন সেটা খুলে বলার দরকার করেনা। তাদের এত কিছু হয়, শত শত কোটি টাকা হয়। তারা এখন হাজার হাজার কোটি টাকা দেশের বাইরেও বিনিয়োগের অনুমতি চায়…. অথচ তাদের কারখানায় কাজ করা শ্রমিকদের জন্য সামান্য খাবারের জায়গা দিতে পারেন না…
এই ছবিগুলো জড়বস্তু হওয়ায় প্রতিবাদ করতে পারেনা।
এই ছবিগুলো কোনোরকম মিটিং-মিছিল-সমাবেশ ডাকতে পারেনা।
এই ছবিগুলো হরতাল ডাকবতে পারেনা।
এই ছবিগুলো ব্যারিকেড ভেঙ্গে সচিবালয় ঘেরাও করতে পারেনা।
তাহলে কি পারে?
সামাণ্য হলেও সংবেদ আছে এমন মানুষকে কাঁদায়।
দ্রোহী করে।
আর ওই সকল চামার-চণ্ডালদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর প্রেরণা দেয়।
মনজুরুল হক
১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬
ঢাকা।