সুশীল প্যারাসাইট বর্ণিত এই ‘সভ্য’ সমাজে প্রতিদিন সূর্য ওঠার মতো নিয়ম করে নারী-শিশু ধর্ষণ হয়। হয়ে আসছে বছরের পর বছর। নিয়ম করে সেইসব ধর্ষণের পর মিডিয়াতে কিছু হৈচৈ হয়, কিছু বিবৃতি-বক্তৃতা আর ব্যবস্থা নেয়ার আশাবাদ হয়, তারপর হিম ঘরে চলে যায় ইস্যুটা অন্যান্য আর দশটা ইস্যুর মতো। এর মধ্যে ‘কেন ধর্ষণ বাড়ছে’ শিরোনামে দিগ্গজ পণ্ডিতের চ্যানেলায়তনের প্যাচাল হয়। বাঘা বাঘা তপ্ত ঘিলুঅলা জ্ঞানের ডিব্বাগুলো মুখ উপচে জ্ঞান বিরতণ করে। এক সময় তাও থিতু হয়ে আসে। এর পাশাপাশি ধর্ষণের পর কোনো কারণে মেয়েটি কিংবা নারীটি অথবা শিশুটি বেঁচে গেলে তাকে নিয়ে চলে বহুপ্রস্থ ‘ধর্ষণায়োজন’।
মূল ধর্ষণকারী বা ধর্ষণকারীগণের পর পরই ভিকটিমকে ‘ধর্ষণ’ করে ডাক্তারা। তার পর ‘ধর্ষণ’ করে আইন-আদালতের লোকগুলো। তারও পর ‘ধর্ষণ’ করে পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজনরা। সর্বশেষ ‘ধর্ষণ’ করে নিজের ঘরের লোকগুলো। কার্যত মেয়েটি বেঁচে থাকলে যখন একাধিকবার ‘ধর্ষিত’ হতে থাকে তখন তার কাছে মৃত্যুই শ্রেয় মনে হয়। সে আত্মহত্যা করে এবং এই ‘রুটিনমাফিক’ পরিণতি এদেশের হাজারও মেয়ের ক্ষেত্রে হয়েছে। হচ্ছে। হবেও হয়তো দীর্ঘদিন। এসব ধর্ষণ ঘটনার মধ্যে সোহাগী জাহান তনু ধর্ষণ এবং হত্যার ঘটনাটি সারা দেশে আলোড়ন তুলেছে। আজ থেকে দেড় যুগ আগে দিনাজপুরের গার্মেন্ট কর্মী ইয়াসমিন ধর্ষণ এবং হত্যার পর যেভাবে দিনাজপুর শহর ফুঁসে উঠেছিল অনেকটা সেভাবেই ফুঁসে উঠেছে কুমিল্লা এবং সেইসঙ্গে ঢাকা। পত্রপত্রিকায় তনুর ধর্ষণ বিষয়ের রিপোর্টটা এরকম-
‘গত ২০ মার্চ রাতে কুমিল্লা সেনানিবাসের সীমানা সংলগ্ন এলাকায় (এ স্থানে কোনো সীমানা প্রাচীর নেই) সোহাগী জাহান তনুর অচেতন দেহ খুঁজে পান তার বাবা ইয়ার আলী এবং তিনি মিলিটারি পুলিশকে খবর দেন। তৎক্ষণাৎ সোহাগীকে সিএমএইচ-এ নেয়া হয় ও সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করে। পরবর্তীতে পুলিশ কর্তৃক তার পোস্টমর্টেম কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়।’
ওই ২০ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত সারা দেশে আরো অন্তত ডজনখানেক ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। খবর প্রকাশিত হয়েছে এর অর্ধেকের। যেমন- ‘পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলায় এক এইচএসসি পরীক্ষার্থীকে ধর্ষণের পর হত্যা করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। নিহত ওই শিক্ষার্থী স্থানীয় সাপলেজা শাহাদাৎ হোসেন মহাবিদ্যালয়ের এইচএসসি পরীক্ষার্থী। মঙ্গলবার সকালে উপজেলার সাপলেজা ইউনিয়নের দক্ষিণ খেতাচিড়া এলাকার একটি ধান ক্ষেত থেকে লাশ উদ্ধার করা হয়। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জানান, ওই শিক্ষার্থী পাশের গ্রামে বড় ভাইয়ের শ্বশুর বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল। মঙ্গলবার ভোর ৬টার দিকে প্রাইভেট পড়ার উদ্দেশ্যে সেখান থেকে বাড়ি আসার পথে অজ্ঞাত দুর্বৃত্তরা তাকে ধর্ষণের পর কিছু দিয়ে মাথায় আঘাত করে থেঁতলে হত্যা করে ফেলে যায়। নিহতের বড় বোন কাজল ঘণ্টাখানেক পর একই পথ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় একটি ধান ক্ষেতে ওই শিক্ষার্থীর লাশ দেখতে পান। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে সকাল ১০টার দিকে গিয়ে নিহতের লাশ উদ্ধার করে। এ ঘটনায় স্থানীয় জনতা সন্দেহ করে একজনকে আটক করার পর পুলিশে দেয় (জাগোবিডি নিউজ ২৫.০৩.২০১৬)।’
‘পাবনার সাঁথিয়ায় কীর্তন শুনতে যাওয়ার সময় এক কলেজছাত্রীকে ধরে নিয়ে পালাক্রমে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা হয়েছে। মঙ্গলবার দুপুরে উপজেলার পুণ্ডুরিয়ার গ্রামের ওই মেয়েটির চিকিৎসার খোঁজ নিতে জেলা প্রশাসক রেখা রানী বালো পাবনা সদর হাসপাতালে যান। সাঁথিয়া থানার এসআই জাকির হোসেন জানান, পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের স্নাতকের ওই ছাত্রী বাদী হয়ে সোমবার দুজনের নাম উল্লেখসহ চারজনকে আসামি করে সাঁথিয়া থানায় একটি মামলা করেছেন। পুলিশ আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালাচ্ছে। পাবনা সদর হাসপাতালের গাইনি বিভাগের কনসাল্টেন্ট সাবেরা গুলরুখ বলেন, মেয়েটির ডাক্তারি পরীক্ষায় ধর্ষণের প্রাথমিক আলামত মিলেছে। তাকে হাসপাতালের গাইনি ওয়ার্ডে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। ধর্ষকরা ঘটনার ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত বাড়ি থেকে বের হতে দেয়নি বলে অভিযোগ করেছেন মেয়েটির মা। তিনি বলেন, ‘ওরা আমাদের বাড়ি থেকে বের হতে দেয়নি। এলাকায় ফিরলে মেরে ফেলবে আমাদের। আমি এর সুষ্ঠু বিচার চাই।’ (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, ১৫.০৩.২০১৬)।’
এরই মধ্যে চট্টগ্রামে কয়েক দুর্বৃত্ত মিলে এক বালককে ধর্ষণ করার অভিযোগ উঠেছে। খবরটি ছাপা হয়েছে ডেইলি স্টার পত্রিকায়।
তনু ধর্ষণের ঘটনা ঘটে যাওয়ার ৫ দিন পর যখন কুমিল্লা-ঢাকাসহ সারা দেশে এর প্রতিবাদে কর্মসূচি পালিত হয়েছে, যখন এই ধর্ষণের বিচার চেয়ে বিভিন্ন সংগঠন রাস্তায় নেমেছে তখনো বড় বড় মিডিয়া হয় কারো ধমকে নয়তো নিজেদের কায়েমি স্বার্থের কারণে ঘটনাটি নিয়ে চুপ করে থেকেছে। তারপরও যখন আন্দোলন-প্রতিবাদ কুমিল্লা থেকে ঢাকায় প্রতিধ্বনিত হয়েছে তখন কিছু কিছু মিডিয়া একটু নড়ে-চড়ে বসে রিপোর্ট করেছে। কিন্তু যাদের এলাকায় ঘটনাটি ঘটেছে সেই কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে ২৫ মার্চ দুপুর পর্যন্ত কোনো সাড়াশব্দ শোনা যায়নি। অথচ দেশরক্ষা বাহিনী হিসেবে, দেশের সংবিধানের প্রতি অটুট আস্থার প্রতীক হিসেবে এবং সর্বোপরি একটি সুশৃঙ্খল দেশপ্রেমিক বাহিনী হিসেবে সবার আগে তাদের ভূমিকা পরিষ্কার করার দরকার ছিল। উচিত ছিল ঘটনাটি ডালপালা মেলার আগেই ন্যায্য বিচারের প্রতিশ্রæতি দেয়া। এ দেশের অন্নে লালিত সেনাবাহিনী দেশের আপৎকালীন অনেক দায়িত্ব পালন করে। বিদেশে গিয়েও ‘শান্তিরক্ষা’ করে। সে বিচারে দেশের মানুষ তাদের কাছে সবচেয়ে নিরপেক্ষ, সবচেয়ে পক্ষপাতহীন এবং ন্যায়নিষ্ঠ ভূমিকা আশা করে। তনু ধর্ষণের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ছিল না। কিন্তু যে কোনো কারণেই হোক টানা চার দিন কুমিল্লা সেনানিবাসের পক্ষে কোনো বিবৃতি আসেনি। সামাজিক মাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক প্রচার-প্রপাগান্ডা হলে, সকারের একাধিক মন্ত্রী বিষয়টি নিয়ে বিবৃতি দেয়ার পর সেনানিবাস থেকে বিবৃতি আসে। তারা বলেছেন-
‘শুক্রবার (২৫ মার্চ) দিনগত মধ্যরাতে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ রেজা-উল করিম শাম্মীর সই করা ও ঢাকা সেনানিবাসের সামরিক গোয়েন্দা পরিদপ্তর জিএস শাখা থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিষয়টি জানানো হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত ২০ মার্চ রাতে কুমিল্লা সেনানিবাসের সীমানা সংলগ্ন এলাকায় (এ স্থানে কোনো সীমানা প্রাচীর নেই) সোহাগী জাহান তনুর অচেতন দেহ খুঁজে পান তার বাবা ইয়ার আলী এবং তিনি মিলিটারি পুলিশকে খবর দেন। তৎক্ষণাৎ সোহাগীকে সিএমএইচে নেয়া হয় ও সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করে। পরবর্তীতে পুলিশ কর্তৃক তার পোস্টমর্টেম কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়। তনু হত্যার কারণ উদঘাটনে ইতোমধ্যে কার্যক্রম শুরু হয়েছে এবং সেনাবাহিনী এ হত্যার কারণ উদঘাটনে পুলিশ/প্রশাসনকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করছে (বিডিনিউজটোয়েন্টিফোর ডট কম, ২৫.০৩.২০১৬)।’
আমরা ধর্ষণ কিংবা মনস্তত্ত্ব বিষয়ের পণ্ডিত নই। সাদা চোখে যা দেখি তার আলোকে বলতে পারি ধর্ষণের মতো সামাজিক অপরাধ যেমন একদিনে গড়ে ওঠেনি, তেমনি রাতারাতি বন্ধও করা যাবে না। ধর্ষণের মূল কারণগুলো চিহ্নিত করে সেখান থেকে সমূলে উৎখাত করতে না পারলে, সমাজের স্বাভাবিক বিকাশ রুদ্ধ করার উপাদানগুলো বিনাশ করতে না পারলে, সমাজে নারীর অবস্থান দৃঢ় করতে না পারলে এবং সমাজে ন্যায়-নীতি-আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে ধর্ষণ থামানো যাবে না। যেটা হবে সেটা ওই প্রারম্ভিকে বলা ঘটনাপ্রবাহ।
এই তথাকথিত ‘সহজিয়া আদর্শ’ সমাজে আজ সবার হাতে হাতে সেল ফোন। কালো টাকা হোক কিংবা অসৎপথে উপার্জিত হোক এই সেল ফোন এখন অনেক অপরাধের সূতিকাগার। পাড়ার দোকানে ৫/১০ টাকা দিলেই ফোন সেটে রগরগে নীল ছবি আপলোড করে নেয়া যায়। সেই সব ছবি দেখে উত্তেজিত হলো সেই কিশোর বা যুবক তার উত্তেজনা প্রশমন করে নিরীহ কিশোরীর ওপর। আর যদি সেই কিশোরী দরিদ্র হয় তাহলে তো কথা নেই। দেশের চলচ্চিত্র নামক ‘স্টুপিড তৈরির কারখানা’গুলো দিনের পর দিন ধর্ষণ-খুন, হত্যা-জখম আর অনৈতিকতার চাষ করে চলেছে। ব্যাজবেজে ঘিলুতে রাজ্যের পাণ্ডিত্য জাহির করা পণ্ডিতরাই এই প্রতিষ্ঠানের সেন্সরবোর্ডে অধিকর্তা হন। তাদের সামনেই, তাদের ইন্ধনেই সিনেমা নামক এসব গার্বেজে দেশের যুব সমাজকে ধ্বংস করার যাবতীয় উপাদান প্রচারিত হয়। ভিলেন নায়িকার বাপের মাথা/হাত কেটে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, সেই মাথা/হাত থেকে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়ছে… এমন ছবি দিয়ে পোস্টার বানানো হয়। এমন কোনো সিনেমা নেই যেটিতে কোনো না কোনো ধর্ষণ নেই! দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু মোটা দাগের অভিভাবকপনার আরেক দৃষ্টান্ত ধর্ষণ শেষে ধর্ষককে ধরেন সালিশের মাধ্যমে ধর্ষকের সঙ্গেই ভিকটিমের বিয়ে করিয়ে দেয়া। সিনেমা, পোস্টার, চটি বই, মোবাইলের মেমরি কার্ডে নীল ছবি, অশ্লীল ভিডিও, গ্রাম্য মাতবদের মামদোবাজি, পুলিশের অশিক্ষা-কুশিক্ষা, আইনের দীর্ঘসূত্রতা, নারীর প্রতি সমাজের সহজাত বৈরিতা এবং ধর্মীয় আবেগে নারীকে ‘গনিমতের মাল’ ভাবার মতো বদমায়েশিগুলো বন্ধ করতে হবে। তারপরই কেবল ধর্ষণ কমানো যেতে পারে। এবং সব শেষে ধর্ষণবিরোধী আইন এত কঠোর করতে হবে যা দৃষ্টান্ত হয়ে উঠতে পারে। ধর্ষণ নিয়ে চ্যানেলে চ্যানেলে ফাঁপা বুলি দিয়ে টিআরপি বাড়ানোর চেয়ে এই বিষয়গুলো বেশি জরুরি।
২৬ মার্চ, ২০১৬
মনজুরুল হক : কলাম লেখক।