একটা সময় ছিল। খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। সে সময়ও এখনকার মত রোজ পুব দিকে সূর্য উঠে পশ্চিম দিকে অস্ত যেত। সে সময়ও রাতের আকাশ মোলায়েম আলোয় ভাসিয়ে দিত শুক্লপক্ষের চাঁদ। সে সময় কিশোর বা তরুণরা ক্লাসের বই পড়ার বাইরেও পড়াশুনো করত। বাড়িতে বাড়িতে এ্যামুজমেন্ট গেজেট হিসেবে ট্রানজিস্টার রেডিও। কারো কারো বাড়িতে খুব বেশি হলে ক্যাসেট প্লেয়ার। সপ্তান্তে বাবা-চাচা আর মা-চাচীরা সিনেমা দেখতে যেতেন। তরুণ-তরুণী, কিশোর-কিশোরীরা পাড়ায় পাড়ায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করত বড়দের কাছ থেকে চাঁদা নিয়ে। কখনো রবীন্ত্র জয়ন্তী, কখনো নজরুল জয়ন্তী, আর কখনো বা সুকান্ত জয়ন্তী। তা ছাড়া বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, একুশে ফেব্রুয়ারি, পহেলা বৈশাখের মত অনুষ্ঠানগুলো করত। বাজারের পয়সা বাঁচিয়ে সিনেমা দেখা, সার্কাস দেখাতেই পূর্ণ হত আনন্দযাপন। সে সময় মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে হয়ত স্বাচ্ছন্দ ছিলনা, কিন্তু সুখ ছিল। হয়ত বিত্ত-বৈভবের ছড়াছড়ি ছিলনা, কিন্তু স্বস্তি ছিল। সময়টাই ছিল সহজিয়া সময়। সহজিয়া সংস্কৃতির সময়। সেই সময়টা পার হয়ে এসেছে বাংলাদেশ। সেটাও রাতারাতি ঘটেনি। ধীরে ধীরে, কিন্তু নিশ্চিত পরিকল্পিত পদক্ষেপে।
বেনিয়া কর্পোরেট ছেনাল সাংস্কৃতি ধীরে ধীরে আমাদের সেই সহজিয়া সাংস্কৃতিকে মূল জড়শুদ্দু উৎপাটন করেছে। শুধু করেই ক্ষান্ত হয়নি, সেই স্থান দখল করেছে ভোগবাদী চণ্ডাল সাংস্কৃতি। এবং সেটার জন্ম, বিকাশ আর সর্বগ্রাসী আগ্রসনে মদদ দিয়েছে রুটলেস শাসককুল। এমনি এমনি? মোটেই নয়। এর পেছনের কারণ খুব পষ্ট। এই সমাজটাকে এমন এক আবেগহীন যান্ত্রিক সমাজে রূপান্তর ঘটানো, যে সমাজে সব কিছুর তুল্য বিচার হবে পণ্য মূল্যে। সবকিছুকে বিবেচনা করা হবে অর্থমূল্যে এবং ভোগবাদে।
ঐশী নামের যে মেয়েটির বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় হয়েছে সেই ঐশী এই ভোগবাদী আধা-খেচড়া ছেনাল কর্পোরেট সমাজের বাইপ্রডাক্ট। কিভাবে এই ধ্বংসোন্মূখ অবস্থায় চলে গেলে মেয়েটি যে তার জন্ম দাতা বাবা আর গর্ভধারিনী মাকে হত্যা করার মত জঘণ্য কাজটি করতে পারে?
ব্যক্তি, পরিবার, পরিবার, রাষ্ট্র, আর সমাজকে জবাবদিহিহীন একরোখা করেছি সকলে মিলে। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে গলিত রাজনীতির নষ্টামী এক আধা-খেঁচড়া খেয়োখেয়ি রাষ্ট্র কাঠামো। যেখানে সন্তানদের এমনভাবে বড় করছি যাতে তাদের মধ্যে ব্যক্তি ভোগবাদটাই মুখ্য হয়ে উঠছে। এবং সেই ভোগবাদে আবিষ্ট হয়ে তার পক্ষে যে কোনো ধরণের অপরাধ করা যেনতেন ব্যাপার।
মোবাইল, কম্পিউটার-ইন্টারনেট-ভিডিও গেইমস-টেলিভিশন, রক, হলিউডি মুভি ছাড়া জীবনকে এখন আর যেন কোনোভাবেও কল্পনা করা যায়না। জীবনের মানে হিসেবে দাঁড়াচ্ছে ইয়াবা কিংবা কোনো ড্রাগস, অথবা জীবনকে ইচ্ছেমত স্যাডিজমে প্রবাহিত করা।
পত্রপত্রিকা, অনলাইন আর টেলিভিশনের সংবাদের ভাষ্য অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে ঐশীর কাছে প্রিয় হয়ে উঠেছিল ইয়াবা এবং তার ইয়াবা-আসক্ত বন্ধুগোষ্ঠি। প্রেমিকার ভালোবাসা পেতে ছেলেটি মায়ের হৃদপিণ্ড ছিন্ন করে নিয়েছিলো, আর এখানে ঐশী তার মা-বাবার। স্কুল-কোচিং-প্রাইভেটের জীবনে হয়তো ঐশী জীবনের প্রথম আনন্দ পেয়েছিলো ইয়াবাতেই। সেখান থেকে ঐশীকে আর ফেরানো যায়নি। এটা যে তার বাবা-মা একেবারেই জানতেন না সেটা মেনে নেয়া কষ্টকর। তবে বাবা-মায়ের ওই না জানতে পারার ভেতরেও এক ধরণের ব্যর্থতা নিহীত। তারা হয়ত বহুভাবে চেষ্টা করেও ফেরাতে পারেননি। কারণ ফেরার পথ হয়ত আরও আগেই রুদ্ধ হয়ে গেছিল।
পত্র-পত্রিকার খবর অনুযায়ী “পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান ও তাঁর স্ত্রী স্বপ্না রহমানকে হত্যার দায়ে তাঁদের মেয়ে ঐশী রহমানকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছেন আদালত। তাঁকে আশ্রয় দেওয়ায় বন্ধু মিজানুর রহমানকে দুই বছরের কারাদণ্ডাদেশ এবং অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় অপর আসামি আসাদুজ্জামান জনিকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়েছে।
ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৩-এর বিচারক সাঈদ আহমেদ এ মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ঐশী পরিকল্পিতভাবে একাই ওই হত্যাকাণ্ড ঘটান এবং মামলার আলামত নষ্ট করার চেষ্টা করেছেন। খুনের সময় তিনি সুস্থ, স্বাভাবিক ছিলেন। আসামিপক্ষ তাঁকে অপ্রাপ্তবয়স্ক বললেও তা প্রমাণ করতে পারেনি। ঐশী থানায় আত্মসমর্পণ করে আদালতে হত্যার কথা স্বীকার করে জবানবন্দি দেন। এই হত্যাকাণ্ড বিবেককে নাড়া দিয়েছে। এটি একটি বর্বর ও নৃশংস ঘটনা। আসামি একজন সন্তান হলেও আইনে অনুকম্পা দেখানোর কোনো সুযোগ নেই। আসামি মিজানুর রহমান ঐশীকে আশ্রয় দেন। আইনে কোনো অপরাধীকে আশ্রয় দেওয়াটাও অপরাধ।
রায়ে বলা হয়, রাষ্ট্রপক্ষ আসামি ঐশী রহমানের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ প্রমাণে সক্ষম হওয়ায় তাঁকে দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলো। বাবা ও মাকে হত্যার দুটি অভিযোগেই তাঁকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। একই সঙ্গে তাঁকে ২০ হাজার টাকা করে জরিমানা এবং অনাদায়ে এক বছর করে কারাদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়।“
যদিও ঐশীর বয়স নিয়ে তার আইনজীবি প্রতিবেদন দাখিল করে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছিলেন যে সে অপ্রাপ্ত বয়ষ্কা, কিন্তু আদালতে সেই আবেদন টেকেনি। আমরা জানিনা উচ্চ আদালতে ঐশীর কী হবে। হতে পারে সেখানেও মৃত্যুদণ্ডের আদেশ বহাল রইল। হতে পারে মৃত্যুদণ্ড মওকুফ হয়ে কয়েক বছর সাজা।
এই বিচারের কয়েক দিন আগেই বহুল আলোচিত সিলেটের রাজন হত্যাকাণ্ড এবং খুলনার রাকিব হত্যাকাণ্ডের বিচারের রায় হয়েছে। শিশু রাজন এবং রাকিবকে যে নৃশংসতায় হত্যা করা হয়েছে তা সভ্য সমাজের ভিত পর্যন্ত নাড়িয়ে দেয়। সে কারণেই হোক কিংবা শিশু হওয়ায় সমাজে, প্রচার মাধ্যমে বাড়তি গুরুত্ব হোক এই দুটি হত্যাকাণ্য নিয়ে দেশের মানুষ সোচ্চার ছিলেন। সে কারণে হোক, কিংবা স্বাভাবিক কারণেই হোক আদালত খুব অল্প সময়েই মামলা দুটির রায় ঘোষণা করেছেন। দুটি হত্যাকাণ্ডের রায়েই অপরাধীর মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা হয়েছে। এবং সেই রায়ে শিশু দুটির বাবা-মা, আত্মিয়-সজন সন্তুষ্ট।
ঐশী মেয়েটার মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। জানিনা উচ্চ আদালতেও রায় বহাল রয়েছে। তবে একথা এড়িয়ে যাওয়া যাবেনা যে সামাজিক মাধ্যমে অগুনতি মানুষ এই রায়ে উৎফুল্ল হননি, বরং বিমর্ষ হয়েছেন। মেয়েটি কেন তারা বাবা-মা’কে নৃশংসভাবে হত্যা করল তা নিয়ে অনেক কিছু বলা যায়। এন্তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, যুক্তি-তক্কো হাজির করা যায়। এই মুহূর্তে খুব একটা প্রয়োজন নেই।
বাবা-মাকে হত্যার মত জঘন্য অপরাধের শাস্তি মৃত্যুদণ্ডে আপত্তি নেই, কিন্তু কেন অপ্রাপ্তবয়ষ্ক মেয়েটি (বয়স নিয়ে বাহাসে রুচি নেই কারণ ১৮ হওয়া মানেই প্রাজ্ঞ হয়ে ওঠা নয়। ফাঁসিতে লটকানোর জন্য যেনতেনভাবে বয়স আঠারো করে দিলেই আইন রক্ষা হয় হয়ত, কিন্তু মানবিকতা রক্ষা হয়না) হত্যাকাণ্ডের মত সিরিয়াস বিষয়টি ঘটাতে গেল? কেন তার বাবা তাকে লক্ষ টাকা হাত খরচ দিতেন। কোথা থেকে দিতেন? দিতে হতই বা কেন? সেই টাকায় যে মেয়ে মাদকাসক্ত হচ্ছে সেটি বাবা-মা জানতেন না তা মেনে নেয়া যায় না। তাহলে এই প্রশ্ন কেন উঠবে না যে তাকে তিলে তিলে ধ্বংস হতে সহায়তাই করেছে বাবা-মা! কিন্তু কেন? আদালত বিচারের সময় একথা বিবেচনাতেই আনলেন না যে পুলিশ কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান কোন সোর্স থেকে তার মেয়েকে মাসে এক লক্ষ টাকা হাতখরচ দিতে পারতেন? তার ডিপার্টমেন্টের শীর্ষ কর্মকর্তারাও ‘মৃত কলিগের’ দুর্নীতি খতিয়ে দেখার মত ‘মৌচাকে ঢিল’ ছুঁড়বেন না। তাতেই কি মাহফুজুর রহমানের অপরাধ লঘু হয়ে যায়? নাকি যাওয়া উচিৎ? আদালতে অপরাধীর শাস্তির প্রধান কারণ সমাজে ওই ধরণের অপরাধকে নিবৃত্ত করা, নিরাময় করা, নিরুৎসাহিত করা এবং চূড়ান্ত বিচারে একটি নজির স্থাপন করা। এখন এই মাদকাক্রান্ত মেয়েটিকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে আদালতে যে নজির স্থাপিত হবে তাতে কি মাহফুজুর রহমানের উত্তরসূরি তৈরির পথ বন্ধ হবে? হবে না, কারণ সেটা ভিন্ন প্রেক্ষিত। তাহলে? বরং ঐশীকে ক্ষমা করে এমন একটা নজির স্থাপন করা যায় যা দেখে অন্তত ‘ঐশী’ হওয়ার প্রবণতা কমতে পারে।
আমরা শিল্প, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ, প্রকৃতির একান্নবর্তীতা ভুলে (অথবা সচেতনভাবে এড়িয়ে) এমন এক মাৎসন্যায় সমাজ তৈরি করেছি যেখানে প্রতি মুহূর্তে মূল্যবোধের অবক্ষয় হাড়ে হাড়ে অনুভব করায়। এমন এক কিম্ভূৎকিমাকার আধা-খ্যাচড়া ভায়োলেন্ট এবং সেলফিস সমাজ তৈরি করেছি যেখানে বনিক ব্যবস্থার অধীনে জাগতিক জীবনের সকল কিছুকে পণ্যমূল্যে নিরুপন করা হয়। সেই সমাজে ন্যায়-নীতি কিংবা প্রচলিত মূল্যবোধ একেবারেই কোনো অর্থ বহন করেনা। তাই নিজের ভালো লাগার কারণে যদি আরেকজনের জীবন প্রদীপ নিভেও যায় তাতে কুণ্ঠা বোধ নেই।
সেই মাৎসন্যায় সমাজে একজন ঐশীর মৃত্যুদণ্ড কোনোভাবেই আরেকজন ‘ঐশী’ তৈরি হওয়া রুখতে পারেনা। অথচ দল্ড কিংবা সতর্কতার অর্থই হচ্ছে ভবিষ্যতে ঘটনাটির পুনরাবৃত্তি রোধ করা। সমাজের খোল-নলচে না বদলে, সমাজে মানুষের মানবিকতাকে জাগ্রত করার সংস্কৃতি উজ্জীবিত না করে একজন ঐশীকে যত কঠোর শাস্তিই দেয়া হোক না কেন কাজের কাজ কিছুই হবেনা।
বরং মেয়েটিকে কয়েক বছর সাজা দিয়ে মানবিকতায় ফেরার সুযোগ দিলে সেটাই হত তার বাবা-মায়ের প্রতি সত্যিকারের শ্রদ্ধা দেখানো। এখানে পুলিশের ‘ডিপার্টমেন্টের লোক’ হিসেবে বিচারে বাড়তি কর্তৃত্বের সুযোগ নেই।
আশা করব মেয়েটি বেঁচে থাকুক। বেঁচে থেকে প্রতি পলে অনুভব করুক বাবা-মা না থাকলে একটি শিশুর জন্য এই বিশ্ব কতটা বৈরী! সেটাই হবে তার জন্য সব চেয়ে কঠোর শাস্তি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ঐশী’র বাবা মাহফুজুর রহমান নিহত না হয়ে মারাত্মক আহত হয়ে বেঁচে থাকলে তিনিও তার মেয়েকে ক্ষমা করে দিতেন। আমার আরও মনে হয় আমাদের মধ্যে এমন অনেক বাবা আছেন যাদের নিজের মেয়ে ঐশীর মত ঘটনা ঘটালেও তারা মেয়েকে ক্ষমা করতেন। বাবা-মা লাশ হয়েও সন্তানকে ক্ষমা করতে পারে, কারণ সন্তানের কারণে বাবা-মা নয়, বাবা-মা’র কারণেই সন্তান। সেই সন্তান মানেই শরীরের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সেই অংশ কি করে হত্যা করা চলে? এখানে ঐশীর ‘বাবা-মা’ এই রাষ্ট্র, এই প্রচলিত আইন, সমাজ। এরাই ঐশী’র অভিভাবক। সেই অভিভাবক (বাবা-মা) কি করে তাদের সন্তানকে ফাঁসিতে ঝোলাতে পারে? কি করে?
মনজুরুল হক
বিচার ব্যবস্থা যতোটুকু সচল আছে সেটুকুও অকার্যকর করে ফেলতে হবে !?। ব্যক্তি ঐশি করুনা কাড়তে পারে; কিন্তু তার অপরাধ তো নিতান্ত অগন্য নয়। এসব হলো মায়াকান্না ।
ঐশীকে মৃত্যুদণ্ড রদ করে অল্প সাজায় ছেড়ে দিলেই বিচার ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে যাবে? তাহলে এ যাবত মহামাণ্য প্রেসিডেন্ট যে ক’জনের মৃত্যুদণ্ড মওকুফ করেছেন তাতে বিচার ব্যবস্থার কি দশা ভাই?