গত ২৩ জুন প্রথম আলোয় ‘যশোর-খুলনা ও যশোর-বেনাপোল মহাসড়ক পুনর্নির্মাণে কাটতে হবে ৫ হাজার গাছ!’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদনে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি অ্যান্ড উড টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের প্রধান মো. এনামূল কবীর বলেছিলেন, গাছগুলো কাটা উচিত হবে না। পাশে গাছ থাকলে সড়কের ক্ষয়রোধ হয়। রাতে গাছে আলো প্রতিফলিত হয়ে দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমে। শতবর্ষী গাছগুলো মহিরুহ হিসেবে কাজ করে। ভারতের মতো এখানেও গাছগুলো মাঝখানে রেখে সড়ক সম্প্রসারণ করা সম্ভব।
এই যে এখানে বলা হল –‘ভারতের মত এখানেও গাছগুলোকে মাঝখানে রেখে সড়ক সম্প্রসারণ করা সম্ভব’। এই ‘সম্ভব’ কথাটি বললেন একজন বিশেষজ্ঞ। বিস্ময়কর হল কোনো পরিবেশবাদী সংগঠন, এনজিও (যারা এন্তার পরিবেশ পরিবেশ বলে হল্লা-চিল্লা করে) কিংবা কোনো পরিবেশ-প্রতিবেশ নিয়ে বড় বড় বুলি আউড়ানো বাম প্রগতিশীল দল এ নিয়ে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ করেনি! আন্দোলন করেনি!
এর পর পরই সরকারের তরফে বলা হয় ‘কোনো গাছ না কেটে পুনর্নির্মাণ করা হবে যশোর-বেনাপোল জাতীয় মহাসড়ক। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যশোর সড়ক ও জনপথ বিভাগকে মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হয়েছে’।
এরপর কি হতে পারে? সিদ্ধান্ত মোতাবেক যে কোনো এক পাশের গাছগুলোকে মাঝখানে রেখে আরেক পাশে রাস্তা সম্প্রসারণ হওয়ার কাজ শরু হতে পারে। অথবা কোনো কারণে কাজ শুরু হতে বিলম্ব হতে পারে, কিংবা সাময়ীকভাবে প্রকল্পটা বাতিল হতে পারে। কিন্তু এই তিনটির কোনোটি না হয়ে যদি ২,৩০০ গাছ কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত হয় তাহলে সরকার, গাছ, রাস্তা, ৪ লেন, স্বার্থ, টাকাকড়ি সব ঘোট পাকিয়ে গুবলেট হয়ে যায়। দুঃখজনকভাবে তা-ই হতে চলেছে।
৬ জানুয়ারি তারিখের খবরে বলা হয়েছে-‘যশোর-বেনাপোল জাতীয় মহাসড়ক পুনর্নির্মাণের জন্য দুই পাশের ২ হাজার ৩০০ গাছ কাটার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আজ শনিবার যশোর জেলা প্রশাসকের সম্মেলনকক্ষে এক মতবিনিময় সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।‘
এই সভা শেষে সওজের নির্বাহী প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলম বলেন, যশোর-বেনাপোল মহাসড়ক কখনোই চার লেন করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত ছিল না। এখনো নেই। তাহলে গাছ কাটা লাগবে কেন, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, প্রকল্পের স্বার্থেই গাছ কাটা লাগবে। প্রকল্প অনুমোদনের সময় সিদ্ধান্ত ছিল, গাছ কেটেই মহাসড়কটি সম্প্রসারণ করা হবে। সওজ বিভাগ থেকে আপত্তি জানালে আবার গাছ কেটে সড়ক সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত হয়।
তার চেয়েও বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে গাছ কাটার বিষয়ে উপস্থিত সরকারি কর্মকর্তা ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের কেউ দ্বিমত করেননি। রাস্তা নির্মাণের পর দুই পাশে নতুন করে গাছ লাগানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। রাস্তার ক্ষতি করবে না, এমন গাছ লাগানো হবে।
এমন অপরিনামদর্শী আমলা-কর্মকর্তা বিশ্বের আর কোথাও আছে বলে জানা নেই। এখানে যে আছে তা তো বোঝাই যায়। এখন প্রশ্ন হল এইসব অবিবেচক, পরিবেশবিরোধী, অর্থ লোভী, গণবিরোধী, ক্ষমতার অপব্যবহারকারী আমলা-কর্মকর্তাদের প্রতিরোধের কি কেউ নেই? ওই অঞ্চলের জনসাধারণ কি এসব মৌলিক বিষয় ভুলে বসে আছে? সরকারের বিশেষ দপ্তর কি করছে? কিইবা করছে বাম প্রগতিশীলরা? তারা দেখি সুন্দরবন রক্ষার জন্য ‘জান কুরবান’ করার ঘোষণা দেয়!
এই সব শতবর্ষী মায়ের মত মমতাভরা গাছ যে রক্ষা করা যায়, রক্ষা করা কর্তব্য সেটা দেখিয়ে দিয়েছে ওই অঞ্চলের কেবলই সীমানার ওপারের জনসাধারণ। বনগাঁয় এই একই রাস্তা প্রশস্তকরণ করতে গাছ কাটার সিদ্ধান্ত আসলেই APDR নামক সংগঠন তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং শেষ পর্যন্ত গাছগুলো রক্ষা করতে পারে(ছবি দ্রষ্টব্য)।
মোটা দাগে এটাই কি সীমানার এপাশ-ওপাশের সাংস্কৃতিক মানদণ্ড? এটাই কি দুই অঞ্চলের জনসাধারণের বোধবুদ্ধির সীমা রেখা?
ধ্বংস করতে করতে সবই তো শেষ করেছে এই জাতি। এখন যা এদের যোগ্যতায় হয়নি, সেই ‘পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা’ পূর্বপুরুষদের রেখে যাওয়া উপহার এভাবেই শেষ করে দিচ্ছে ইনস্ট্যান্ট বার্গার গিলে অভ্যস্ত আধুনিক ইতরসাদৃশ্য ক্লিব মানুষ, যাদের নেতৃত্বে আছে প্রবল ক্ষমতা ব্যবহারকারী আমলা-কর্মকর্তা আর ভোটের নিক্তিতে সব কিছু মাপতে চাওয়া অপরিনামদর্শী সরকার।
এখনও সময় ফুরিয়ে যায়নি। কেউ কি আছেন গাছগুলো বাঁচাতে রুখে দাঁড়াবেন? কোনো দল? কোনো গোষ্ঠি? কোনো ব্যক্তি গ্রুপ? ও ভাই শুনছেন? শুনছেন ভাই?
৭ জানুয়ারি, ২০২৮