
তাই-ই। ধর্ষণের মনস্তত্ত্ব কোনো রকেট সায়েন্স নয়। আমাদের মত সাধারণ মাথাতেই যখন এই মনস্তত্ত্ব ধরা পড়ে তখন টগবগ করে ফুটতে থাকা ঘিলুভর্তি মাথা যে ধড়ের ওপর বসানো থাকে তারা এই মনস্তত্ত্ব বুঝতে পারবেন না সে কি করে মানা যাবে? আচ্ছা, আরেকটু সাদাসিদে করে বলা যাকঃ
ধর্ষণ কেন হয়?
(১) ধর্ষক তার অবদমিত যৌনাকাঙ্খা মেটানোর জন্য নিজের অক্ষমতার কারণে প্রচলিত পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করতে পারে না, আবার যৌনাকাঙ্খার মুখেও লাগাম পরাতে পারেন যখন, তখনই বলপূর্বক ধর্ষণ করে। সেটা হাসিল সাপেক্ষ। অর্থাৎ চটজলদি যাকে সামনে পাওয়া যায় তাকেই ধর্ষণ করার নিমিত্ত।
(২) প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান হলে ধর্ষণ ব্যাপারটা সবচেয়ে বেশি। এটার পেছনে কোনো বাড়তি মনস্তত্ত্ব কাজ করে না। সিম্পল ইকোয়েশন- ‘ওরে আমার চাই’! এক্ষেত্রে মেয়েটিকে ধর্ষক তার নিজস্ব সম্পত্তি জ্ঞান করে।
(৩) মোবাইল, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, পেনড্রাইভে সস্তায় অ্যাডাল্ট মুভি দেখে কামতাড়িত হয়ে সামনে যাকে পাওয়া যায় তাকেই ধষর্ণ করে রাগমোচন করে। এক্ষেত্রে শিশু হলে তাকে ধরতে, ডেকে নিতে, শোয়াতে এবং ধর্ষণ করতে বল প্রয়োগ করতে হয় না বলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শিশুকেই ধর্ষকরা টার্গেট করে।
(৪) জন্মের পর থেকে গ্রামের বাড়িতে/শহরতলিতে মা-চাচি-খালা-ফুপু এবং ভাবীদের কথোপকথনে যৌনাকাঙ্খা অংকুরিত হয়। বন্ধুদের হাস্যরসে সেই আকাঙ্খা পল্লবিত হয়। অ্যাকশন মুভির ভিলেনকে দেখে পল্লবিত আকাঙ্খা চরিতার্থ করার একমাত্র পদ্ধতি হয়ে ওঠে বলাৎকার। কেননা বলাৎকারে এক ধরণের পৌরুষ দেখানোর ব্যবস্থা থাকে। থাকে চরমানন্দ পাওয়ার উত্তেজনাও।
(৫) জন্মের পর থেকেই সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ধর্ষক দেখে এসেছে সংস্কৃতি এবং সাংস্কৃতির প্রতি বাঁকে বাঁকে বিদ্ধ করা প্রবিষ্ট করা গেঁথে ফেলা ঢুকাইয়া দেয়া বিন্ধাইয়া দেয়া হান্দাইয়া দেয়া ভইরা দেয়া কচু দেয়া আইক্কা বাঁশ দেয়ার মত ঘৃণ্য জঘন্য যৌনাচারগুলো অবলীলায় বাবা-মা-ভাই-বোন থেকে শুরু করে পরম গুরুজনদের মুখেও আকসার উচ্চারিত হয়, এবং সবগুলো ‘ভইরা দেয়ার’ টার্গেট নারী।
এরকম আরও ডজন ডজন উপাদান উল্লেখ করা যায় বিষয়টি ব্যাখ্যার জন্য। তবে যে পাঁচটি বলা হয়েছে তা-ই যথেষ্ট যদি কেউ বুঝতে চান। যারা বুঝতে চাইবেনই না তাদের কথা আলাদা।
ধর্ষণ করে কারা?
গ্রামে এবং শহরতলির নিম্নবিত্ত, নিম্ব মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত পরিবারের লোকরাই ধর্ষণে প্রথম। এদের মধ্যে তারাই ‘অগ্রগামী’ যাদের কোনো না কেনোভাবে রাজনৈতিক শেল্টার আছে, বিশেষ করে সরকারী দলের শেল্টার আছে, মাথার উপর ক্ষমতাবানদের হাত আছে, ধনাঢ্য পরিবার, জোতদার পরিবারের সদস্য। দ্বিতীয় সারিতে আছে দীর্ঘদিন নারীসঙ্গ বর্জিত মাদ্রাসা-মক্তব-মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন, খেদমতগার, পাহারাদার এবং মাদ্রাসার শিক্ষার্থী। তৃতীয় দলে আছে বিপত্নিক, বউ গ্রামে রেখে আসা গার্ড, ড্রাইভার, পিয়ন, কেরানি, পাড়ার বখাটে, দোকানদার, নেতার চার্লি, বাড়ির কেয়ারটেকার, দূরসম্পর্কের আত্মিয়, মামাতো-খালাতো ভাই, বেয়াই, দুলাভাই ইত্যাদি।
এইসব ক্যাটাগরির বাইরেও যে কোনো পুরুষ যে কোনো সময় যৌনতাড়িত হলে এবং সে যদি শিশ্নসর্বস্ব হয় তাহলে যে কাউকে বাগে পেলে ধর্ষণ করতে পিছপা হয় না। এটা ‘বোরিং এলিমেন্টস’ এর ন্যাচারাল ফেনোমেনন। এই ক্যাটাগরি নিয়ে আরও পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লেখা যেতে পারে। ব্যাপারটা যেরকম দুই লাইনে বলা হল তা নাও হতে পারে। সে কারণেই বিশদে ব্যাখ্যার দাবী রাখে। তবে মাধ্যম হিসেবে এখানে বিস্তার করা গেল না।
পরিশেষে ধর্ষণ একটি পুরুষাকার। একটি ব্যাধি। একটি সংস্কৃতি। একটি সিস্টেম। ধর্ষক বরাবরই ক্ষমতা বলয়ের লোক কিংবা ক্ষমতার স্টেকহোল্ডার বা ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা শক্তসমর্থ লোক কিংবা যুবক অথবা কিশোর। ধর্ষনের ভিকটিম বরারবরই দরিত্র পরিবারের দুর্বল শিশু, অসহায় নারী, ক্ষতাহীন পরিবারের কিশোরী, একাকী প্রৌঢ়া, গরিব পরিবারের কিশোর/কিশোরী, ছিন্নমূল, দরিদ্র এবং নিরাপত্তাহীন শিশু-কিশোরী আর প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানকারী মধ্যবিত্ত শালিন পরিবারের অবগুণ্ঠিত নারী বা কিশোরী।
ধর্ষণ যদি একটি পুরুষাকার, একটি ব্যাধি, একটি সংস্কৃতি, একটি সিস্টেম। ধর্ষক বরাবরই ক্ষমতা বলয়ের লোক কিংবা ক্ষমতার স্টেকহোল্ডার বা ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা শক্তসমর্থ লোক কিংবা যুবক অথবা কিশোর হয় তাহলে রাষ্ট্র আইন দিয়ে এই সবকয়টি উপাদান নির্মূল করতে পারে। সামাজিক প্রটেকশন পরে আসবে। রাষ্ট্রের প্রধান এবং অন্যতম কর্তব্য হল ধর্ষণ যে চরম শাস্তিযোগ্য অপরাধ সেটা প্রমাণ করা। সেই শাস্তি যে ধর্ম-বর্ণ-দল-ইজম-ক্ষমতাশালী-ক্ষমতাহীন নির্বিশেষে সমানভাবে প্রযোজ্য সেটাও প্রমাণ করা। এটা কোনো একক গ্রুপের বা গোষ্ঠির কাজ নয়। এটা রাষ্ট্রের কাজ। রাষ্ট্রকেই প্রমাণ করতে হবে সে ধর্ষক পয়দা করে না, স্টক করে না, ডিস্ট্রিবিউট করে না। উপরন্তু তার নাগরিককে নিরাপত্তা দেয়, সাচ্ছন্দ দেয়, অভয় দেয়, আত্মসন্মান দেয়। রাষ্ট্র কাকে দিয়ে সেই কাজটি করাবে সেটা রাষ্ট্রের নীতি এবং কৌশলের প্রশ্ন।
যে রাষ্ট্র এসব পারে না বা পারবে না সে রাষ্ট্র ব্যর্থ রাষ্ট্র। নিঃসন্দেহে ব্যর্থ