
ভ্লাডিভস্টক থেকে দলে দলে শ্রমিকেরা ছুটে এসেছিল। বীরোচিত নাবিকেরা বিরতীহীন ভেঁপু বাজিয়ে যাচ্ছিল… আচ্ছা, সত্যিই কি স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধ হয়েছিল? যদি হয়ে থাকে তাহলে এটা কোন পৃথিবী? এখানে স্তালিন নেই কেন? এই সব প্রশ্নের সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের মগজ যখন আপনিই ফালাফালা হয়, তখন হয়তোবা খানিকটা আন্দাজ করতে পারি কেন ‘আস্ত’ থাকাকে প্রবল ও তীক্ষ্ণ ভাষায় অস্বীকার করেছিলেন মিতবাক এই মানুষটি। নবারুণ!
আমাদের প্রচলিত গড়চিন্তা থেকে মনে হয়, তাঁর সাজিয়ে যাওয়া অক্ষররা আসলে অস্বীকারেরই কথামালা। বেচামণির বশীকরণ মন্ত্র পড়া নিয়ে ভদির খচে যাওয়া ও সে সূত্রে বিবাদের একটু পরে গিয়েই লখক বলবেন, ‘কিন্তু এই বিবাদে জড়িয়ে পড়লে আমাদের চলবে না। মাগি-মদ্দার কারবারে আদ্যিকাল থেকেই এই ঢং। ঠাকুর দেবতারাও এই লাইনে যথেষ্ট বলশালী। এসব চলবেই এবং এর রকমফের নিয়ে আধবুড়ো কিছু গান্ডু শারদীয়া কত কী-তে আধলা নামাবে এবং বাঙালি পাঠকরা মলাঙ্গা লেন বা মঙ্গোলিয়া, যেখানেই থাকুক না কেন সেগুলি পড়ে ফেলবে। পড়ে তো ফেলেই। এই অসুখের একমাত্র নির্ভরযোগ্য ট্রিটমেন্ট হল হনুমানের বাচ্চা। কিন্তু সেখানেও ফ্যাকড়া। পশুপ্রেমীরা হাঁউ হাঁউ করে উঠবে। নিরপরাধ, ঐতিহ্যবাহী, রামভক্ত, হনুমানের বাচ্চাদের আপনারা কোথায় পাঠাচ্ছেন! জায়গাটা খাঁচা হলেও বা একটা কথা ছিল।’
ভাষাবন্ধনের মুচকি হাসিটা থামলে আমরা ঠিকই বুঝে যাই, নবারুণ মোটেও আমাদের হাসাতে চাইছেন না। বরং তাঁর কলম নির্দেশ ঐ ‘অসুখ’টার দিকে। কীসের অসুখ? যে কারণে কামুর ‘ আ হ্যাপি ডেথ’ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তাঁর অসুবিধা হয়েছিল।
বিপ্লবে বিশ্বাস হারনানি বলেই তিনি বলতে পেরেছিলেন, ‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না’। যে সময়ে দাঁড়িয়ে ২৪ ঘণ্টা অন্যের উপর নির্ভরশীল থেকে, ‘ ভাবনার বেলায় নিজের অস্তিত্বের বেলুন ফঁপানো ও কয়েকটি পণ্যের বাজারদর ও ম্যাগাজিনের রসদ নিয়ে’ খুব ভালো কবিতা লেখা বা ছবি আঁকা , গান গাওয়া সম্ভব কিনা তা নিয়ে তিনি নিজেই সন্দিহান, যে সময়ে তিনি নিজেই জানেন মাঝারি মাপের হয়ে যাওয়াটাই সহজ পন্থা এবং ‘ব্রয়লার মুরগী হওয়ার থেকে কাক হওয়া অনেক ভালো, সেই সময়েও তিনি, এবং সম্ভবত একমাত্র তিনিই বলতে পারেন, ‘ শত আঘাত,সহস্র পরাজয়, লক্ষ মরণ – কোনও কিছুই আমাকে বিপ্লব ও মুক্তির পথ থেকে সরাতে পারবে না। তার কারণ, আমি রাজপথে ফেলে রাখা বোমা নই। আমি মানুষ। আমি লিখি। এবং আমি সংক্রামক। আমার ক্রাচের শব্দ আপনাকে ডাকছে।’ এই হল অবস্থানের সেই স্থানাঙ্ক অসীম পথের সঙ্গে যে সম্পর্ক পাতিয়ে নেয়। ফলত তাঁর অভিমুখ হয়ে ওঠে শিকড়ের দিকে, এবং সেখান থেকেই সে খুঁজে নেয় আধুনিকতার উৎসমুখ।
তাইই। মৃত্যুর পরে স্বপ্নের পর স্বপ্নের পর সাঁই সাঁই ফ্যাৎ ফ্যাৎ। কেননা আমরা তো এখনো দিব্যি শুনতে পাচ্ছি, তিনি বলছেন, ‘ …কিছু না বলা কথা ট্রাজিক অবলার মতো নির্বাক থেকে বার বার সেমিজে চোখ মুছুক এমনটি নিশ্চিয়ই হওয়া বাঞ্ছিত নয়, বাঞ্চতিত তো নেভার-ই নয়।’
ফ্যাতাড়ুরা উড়ে যায়, পুড়ে যায় না। পেট্রলে ঠিকঠাক আগুন জ্বলে।
যে মানুষরা গেরিলা যুদ্ধেই নিজেদেরকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন নবারুণের শ্রদ্ধা ছিল তাদের প্রতি। সেখানেই নবারুণ সত্তর আশি এমনকি নব্বইয়ের তাবড় তাবড় মার্ক্সবাদী লেখক-কবিদের থেকে পুরোটাই আলাদা। তিনি বরারবরই পাঠককে একের পর এক বানী দিয়ে গেছেন- আমরা এক অদ্ভুত অন্তহীন জড়তা এবং অনতিক্রান্ত বৃত্তের ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছি। তিনি সেখান থেকেই আমাদের ওই স্থানুদশা থেকে টেনে বার করতে চেয়েছেন। .. বলে চলেছেন…… কখন কী ঘটে বলা যায় না। থানা আক্রমণ হতে পারে, পাতালে বোম ফাটতে পারে, ভদির বমি হতে পারে শ্মশাণে অকস্মাৎ তোষকের ভেতর শুয়ে থাকা বোমা ফাটতে পারে। তিনি অদ্ভুত নৈব্যক্তিকতায় বলে চলেছেন-শাসকরা জানতেও পারবে না কখন কোথায় কোন বোমাটা ফেটে যাবে।
তিনিই প্রথম বাংলা সাহিত্যে বুলগাকভকে নিয়ে আসছেন। তিনি যে লেনিন-স্তালিনের লোমকূপে লোমকূপে বিচরণ করার স্বপ্ন বোনেন, সেই তিনিই সে সময়কার সোভিয়েতবিরোধী সাহিত্যিকদের তুলে আনেন। মিথ তৈরি করেন।
তার হাত ধরেই বুলগাকভের ‘দ্য ডগস হার্ট, দ্য ফ্যাটাল এজ’, দ্য মাস্টার এন্ড মার্গারিটা’র মত অমর সৃষ্টি বাঙালি পাঠকের নাগালে আসে।
পেট্রল দিয়ে আগুন নেভানোর গল্প করেছিলেন নবারুণ। কেউ না জানলেও ঠিক জানতেন পেট্রলে আগুন নেভে! এই স্বপ্নটাকে সঞ্চারিত করেছিলেন সত্তরের দশকে চোট খাওয়া নক্সালিদের। নব নব স্বপ্ন ফেরি করেছিলেন এই স্থীর কিংকর্তবিমূঢ় প্রজন্মের কাছে। অন্ধের দেশেও চশমা বিক্রি করার আপাত ফ্যান্টাসি কিন্তু ভয়ঙ্কর জরুরি কাজটাতেও হাত দিয়েছিলেন। পারেননি সবটা। দুম করে শেষ হয়ে যেতে হয়েছে অযত্নে লালিত শরীরটাকে। আজকের এই দিনেই। যেন পণই করেছিলেন- কমরেড চারু মজুমদাদের শহীদ হওয়া মাসেই তাকে চলে যেতে হবে! কী জানি, হয়ত কোনো রাগও থাকতে পারে।
আমরা তোমাকে স্মরণ করার সময় তোমার কালে ফিরব… ক্যাট, ব্যাট, ওয়াটার, ডগ, ক্যাট, ব্যাট….
[গত চার বছরেও ভাষাবন্ধনের পরের কাজটি হল না। মোটের ওপর ১৫/১৬ জন মানুষের কাঁধে চেপে অত বড় মহানগর কলকাতা ছেড়ে শ্মাশাণে যেতে হয় যে মানুষটিকে তার আরাধ্য কাজ তার মরণে থেমে যাবে এটাই গত্যান্তর। নয়কি?]
মনজুরুল হক
ঢাকা
৩১ জুলাই, ২০১৮