ছ’সাত বছরের শিশুর যোনি ব্লেড দিয়ে চিরে ধর্ষণ করা। চার-পাঁচ বছরের শিশুকে ধর্ষণ করে হত্যা করা। সাত-আট বছরের শিশুকে ধর্ষণ করে গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে মারা। বাসের যাত্রী কলেজছাত্রীকে গণধর্ষণ করে হত্যা করা। ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে কিশোরীকে ধর্ষণ করে হত্যা করা। দুই বছরের শিশু থেকে আশি বছরের বৃদ্ধাকেও ধর্ষণ করা। নারী-পুরুষ না পাওয়া গেলে গরু-ছাগল, এমনকি মুরগি পর্যন্ত ধর্ষণ করার ঘটনাগুলো হাজার হাজার ঘটনার মাত্র কয়েকটি যা পত্রপত্রিকায় প্রকাশ হয়েছে। এরকম আরও হাজার হাজার নৃশংস বিভৎস কদাকার ঘটনা আছে যা কখনও আরোর মুখ দেখে না।
ঠান্ডা মাথায় হত্যা করা। ছেলেকে পাশ করায়নি কেন, সেই ‘অপরাধে’ শিক্ষককে হাতুড়িপেটায় হত্যা করা। জমির বিরোধে দল বেঁধে প্রতিপক্ষকে হত্যা করা। মাকে হত্যা করা বাবাকে হত্যা করা। পরিবারের সবাইকে হত্যা করে জমি দখল করা। সামান্য ছাগলে গাছ খাওয়ার ঘটনায় হত্যা করা। দশ টাকার জন্য হত্যা করা। মোবাইলে ভিডিও দেখা নিয়ে হত্যা করা। বলাৎকার করতে না দিলে হত্যা করা। কথা কাটাকাটির জেরে হত্যা করা। প্রেমে প্রত্যাখ্যান হয়ে হত্যা করা। চাঁদা না দেয়ায় হত্যা করা। রাজনৈতিক বিরোধে হত্যা করা। ধর্মকে বাপ-দাদার এজমালি সম্পত্তি ভেবে ধর্মের দোহাই দিয়ে হত্যা করা। নিজের অপরাধ ঢাকার জন্য হত্যা করা। এসব পাবলিক হত্যাকাণ্ড। সরকারী হত্যাকাণ্ড আরও যে কত ভয়াবহ এবং নির্লিপ্ত তা ভাষায় প্রকাশ করাও ঘৃণার্হ।
এবং সেই হত্যাগুলো বিস্ময়কর! সেই হত্যাকাণ্ডগুলো ঠাণ্ডা মাথার ম্যানিয়াক ছাড়া আর কারো করার কথা নয়। বর্হিবিশ্বে ম্যানিয়াকরাই এভাবে হত্যা করে। এদেশে সেটা ডালভাতের মত সহজ-সস্তা। গুলি করে হত্যা, চাকু মেরে হত্যা, তলোয়ার দিয়ে দ্বিখণ্ডিত করে হত্যা, ইটের উপর মাথা রেখে আর এক ইট দিয়ে থেতলে হত্যা, গলায় দড়ে বেঁধে হত্যা, হাত-পা কেটে নিয়ে হত্যা, শরীর খন্ড খন্ড করে হত্যা, হত্যা করে টুকরো টুকরো করে গরু দিয়ে খাইয়ে দেয়া, মলদ্বারে হোসপাইপ দিয়ে বাতাস ঢুকিয়ে হত্যা, জিহ্বা কেটে হত্যা, পানিতে চুবিয়ে হত্যা, বাস-ট্রাক উঠিয়ে হত্যা, বিষ খাইয়ে হত্যা, চাপাতি দিয়ে বটি বটি করে হত্যা, ঘরে আগুন দিয়ে জ্যান্ত পুড়িয়ে হত্যা, ভবনে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে কয়লা করে হত্যাসহ এমন সব হত্যার পদ্ধতি এদেশে ব্যবহৃত হয় যা মনোবিজ্ঞানের বিরাট গবেষণার বিষয় হতে পারত, কিন্তু এইসব ম্যানিয়াক সিরিয়াল কিলিং দেখে দেখে এই সমাজ এতটাই ইউজ-টু যে বিশেষজ্ঞরাও এ নিয়ে চিন্তিত নন। সরকার ভাবিত নন। সুশীল সমাজ কনসার্ন নন। যেন এসব পূর্ব দিকে সূর্য ওঠার মত চিরসত্য!
এইসব তুচ্ছতাতিুচ্ছ ঘটনায় এইরকম নির্লিপ্ত স্যাডিস্ট ম্যানিয়াক কিলিং করছে কারা? শিল্প-সাহিত্যে-নাট্য-চলচ্চিত্রে এক শ্রেণির কাণ্ডজ্ঞানহীন একদেশদর্শী ভাড়াটে লেখকরা যাদেরকে অবিহিত করছে- “সহজ-সরল, নিরীহ-নির্বিবাদী, কাদামাটির মত নরম স্বভাব, পরোপকারী, অতিথিপরায়ণ”…. এই জনপদের মানুষ। এসব যারা রচনা করেছিলেন তারা যে বাস্তবতার নিরীখে করেননি বলা বাহুল্য। যেমন আন্দাজে মনের মাধুরী মিশিয়ে – ‘সবুজ সুফলা-শস্য শামলা’ বাংলাদেশ বলে দিয়েছে। অথচ বাংলাদেশের বনাঞ্চল হার বিশ্বের একেবারে নিচের দিকে। এরা স্কটল্যান্ড কানাডা-অস্ট্রেলিয়া-যুক্তরাষ্ট্রের সবুজ দেখেনি, স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি।
এই সংকটের গোঁড়া কোথায় সেটা মনোবিজ্ঞানী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আর সমাজবিজ্ঞানীরা খুঁজে দেখে প্রতিকার করবেন। তবে বাস্তবতা বলে তারা এসবের কিসসু করেননি, করবেনও না। এই সংকটের মূলে বস্তাপচা বাতিল সামন্তবাদী শিল্প-সাহিত্য আর প্রবাদ। দেশের প্রায় ৮০ ভাগ মানুষের ইন্টেলিজেন্স তৈরি হয় গ্রাম্য প্রবাদ আত্মস্থ করে। যেমন লেখা পড়া না জানলেও তারা শিখে নেয়- ‘নদীর জল ঘোলা ভালো- জাতের মেয়ে কালো ভালো।’ ‘মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেস্ত’! ‘স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেস্ত’। ‘ছেলে হলো বংসের বাতি’। ‘নারী চরিত্রম দেব ন জনন্তি কুতঃ মনুষ্য’। ‘নারী ছলনাময়ী’। ‘মায়ের শিয়রে পানির গ্লাস নিয়ে সারারাত দাঁড়িয়ে থাকাই মাতৃভক্তি’। ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা’। ‘আপনি বাঁচলে বাপের নাম’। ‘পাগলও নিজের বুঝ বোঝে’। ‘বার হাত বাঙ্গির তের হাত বিচি’। ‘পেটে খেলে পিঠে সয়’। ‘আগের হাল যেদিকে যায় পিছের হালও সেদিকে যায়’। ‘পাহাড়ে ঢিল মারতে নেই’। ‘শিশুকে পাখির বাসা দেখাতে নেই, স্ত্রীকে মনের কথা বলতে নেই’। ‘নারীর মন দেবতাও বোঝে না’। ‘নারীর ইবাদত কখনও পুরুষের সমান হবে না’…. এরকম হাজার হাজার অসত্য অর্ধসত্য বিকৃত সত্য সামন্তবাদী কুৎসিত কদাকার স্বার্থান্বেষী বর্ণবাদী লিঙ্গবাদী অঞ্চলবাদী ক্ষমতাবাদী শয়তানি-বজ্জাতি, ধাপ্পাবাজী-ক্ষমতাবাজী, ধর্মবাদী-ইজমবাদী তুক তাক মন্ত্র তন্ত্র আর ওয়াজের নামে রগরগে যৌনাত্মক মর্মকথা ধর্মকথা, হিংসা-দ্বেষ বর্ষণ এবং বেশুমার পরনিন্দাচর্চা হলো এইসব নির্বিকার অপরাধ, তার ব্যাকফায়ারে বিভিৎস খুন এবং জঘণ্য বিকৃত লোকাচারই এই জনপদের মানুষদের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট।
১৬/১৭ কোটি মানুষের অন্তত ৬/৭ কোটি মানুষের সাহিত্যবোধ রাজনৈতিকবোধ এবং মানবিকবোধ থাকা আবশ্যক ছিল- নেই। স্বল্পকালে হওয়ার কোনো সুযোগও নেই। চার থেকে সাড়ে চার কোটি শ্রমজীবীর শ্রম-দাসত্ব-মুক্তি সম্পর্কে মিনিমাম বোধ থাকা উচিৎ ছিল- নেই। এইসব শ্রমজীবী এবং আধা গতরখাটা খাটা মানুষদের এই বিশাল সংখ্যা নিয়ে সমাজটাকে আমূল বদলে দেয়ার প্রক্রিয়া এগোনোর কথা ছিল- এগোয়নি।
সম্ভবত এতকিছুর পরও কোথাও না কোথাও টানেলের শেষ মাথায় আলোর দেখা মেলে! নইলে সবাই এমন নির্লিপ্ত থাকে কী করে? সেটুকুই শেষ ভরসা।