দিনগুলো কেমন ঘটনাহীন কেটে যাচ্ছিল। ক’দিন আগে এত এত ঘটনা ঘটেছিল যে এখন সারাদিনের এত এত কাজের পর ও মনে হতে লাগল কোথাও কিছু হচ্ছে না….বিকেলে মাথাভাঙ্গা নদীর পাড়ে গিয়ে বসে থাকি। যুদ্ধ শুরুর আগে ছিলাম হাসপাতালপাড়ায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সেই একই মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা রোড ধরেই এই শহরে এসেছি। সেই চিরচেনা শহর, কিন্তু যে পাড়ায় উঠেছি সেটা আমার জন্য খুব পরিচিত নয়। এমনি শহরের সব জায়গাই যেমন চেনা মনে হয় এই পাড়াটাও তেমনি। সম্ভবত ওই পাড়াটার কোনো নামও ছিল না! বড় বাজারের পাশে বা পেছনে। ব্রিজের গোঁড়া থেকে নদীর ধার ঘেসে যে রোডটা বড়বাজার পেরিয়ে আরও ভেতরে চলে গেছে সেখানেই একটি পরিত্যাক্ত বাড়িতে আমাদের ঠাঁই হলো।
এ পাড়ায় আমার কোনো বন্ধু নেই। আমার কোনো কাজও নেই। বাবা একদিন নিয়ে গেলেন ভি.জে (ভিক্টোরিয়া জুবলি) স্কুলে, যে স্কুলে আমি ক্লাস ফোর পর্যন্ত পড়েছিলামও। অফিস থেকে বলে দিল যে ক্লাসে পড়ত তার উপরের ক্লাসে ভর্তি করে নেবে। এর নাম নাকি অটো প্রোমোশন। কি কারণে যেন আমাকে ভর্তি করা হলো না।
একটু হেঁটে গেলেই মাঝারপাড়া। সেখানে সেই একেবারে ছোটবেলার বন্ধুরা আছে। ইমদাদাদুল কাকাদের বাড়ি আছে। আছে ভাঙ্গাড়ির বাড়িও। কিন্তু কেন যেন আমার যাওয়া হয় না। আমি সারাদিন বাড়ির সামনের রোয়াকে বসে থাকি। বিকেলে নদীর পাড়ে। আর রাত হলে ব্রিজের নিচের দিকের একটা ল্যাম্পপোস্টের নিচে। চুয়াডাঙ্গা শহরের এত জায়গা থাকতে কেন আমি ওই একটি বিশেষ ল্যাম্পপোস্টের নিচে বসে থাকতাম সেটা সে সময়কার বোধ দিয়ে বোঝার সাধ্য নেই। ছিলও না।
আমি কাঁদতাম। চিৎকার করে কাঁদতাম, কিন্তু শব্দ হতো না! লোহার পোস্ট জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতাম। এই কান্না বেতাই, লালবাজার, মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প ছেড়ে আসার জন্য কিংবা সেই নাম না দেওয়া বিড়ালটার জন্যও না। যে জগা বুড়ো গোপালগঞ্জের টানে কথা বলত… যাকে আমার আপন দাদুর মত মনে হতো তার জন্যও না। সেই যে জগন্নাথদা’ যে আমাকে লাল পতাকা কী তা শিখিয়েছিল, তার জন্যও না। অথচ আমার মনে হতো কোথায় যেন আমি কি ফেলে এসেছি! কি যেন আমি ছেড়ে এসেছি, যার নাম আমি জানি না।
কার পরামর্শে অথবা এমনিই রেলস্টেশনে গিয়ে ওভারব্রিজের উপর উঠে দাঁড়িয়ে থাকাও কেমন যেন ‘ডিউটি’ হয়ে উঠেছিল। এভাবেই একদিন স্টেশনের বুকস্টলে উৎসুক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম। স্টলের মালিক কি মনে করে বিরক্ত হলেন না, উল্টে জিজ্ঞেস করলেন;
‘কি গো খুকা, বই দ্যাকচো? কিনবা নাকি?
‘টাকা নেই কাকা’!
কাকা বলায় বা কি জন্য জানি না লোকটা হঠাৎই বলে বসলেন;
‘সে না হয় পরে দিওকুনি, কি বই লাগবে নেও’…
আমি শশব্যস্ত হয়ে একটার পর একটা বই বাছতে শুরু করলাম…। কি সব সুন্দর সুন্দর নাম- ‘পাখনায় গান গায়’, ‘ইশকুল’, ‘আমি কেন বাবার মত’, ‘কুৎসিৎ হাঁসের ছানা’, ‘কার কেমন ধারা’, ‘জাহাজ ভাসে সাগর জলে’…. আর কত কত লেখকের নাম! নোকোলাই গোগল, বরিস পলেভয়, আলেক্সান্দর কুপ্রিন, ভাসিলি পলিসকিন…. এইসব লেখকের বই একগাদা গুছিয়ে ফেলেছি। কাকা হেসে উঠলেন-
‘এই সব তো দিতি পারবো না খুকা, দুচাইটা নেও’।
আমি নিজেই শেষ পর্যন্ত তিনটি বই নিলাম। বার বার কথা দিলাম দুএকদিনেই টাকা দিয়ে যাবে। কিন্তু বাড়ি ফেরার সময় মনে হলো, টাকা পাব কোথায়? কিভাবে দেব?
রাতে যখন হ্যারিকেনের আলোয় একটা বই খুলে বসলাম, কীভাবে মধ্যরাত হলো বুঝলাম না। মা ধমকে উঠলেন। ওভাবেই ঘুমিয়ে পড়লাম বুকের ওপর খোলা বই………
চলবে…