আর্কিমিডিস, আইনস্টাইন, পিথাগোরাস, ডারউইনের তত্ত্বসমূহ দিয়ে আর হিসেব মেলানো যাচ্ছে না| অ্যালগারিদম মুখ থুবড়ে পড়ে আছে| এ প্লাস বি হোলস্ক্যয়ারের ইক্যুয়ালটু যা হওয়ার কথা তা হচ্ছে না| সমাজে অভাব, অত্যাচার, নিপীড়ন, শোষণ প্রকট হয়ে উঠলেও তারুণ্য দ্রোহী হচ্ছে না| সারি সারি লাশ দেখেও প্রশ্ন জাগছে না| ফরেনসিক ক্যারিক্যাচারে যুক্তি মিলছে| চরম শ্রেণীবিদ্বেষেও শ্রেণীঘৃণা আছড়ে পড়ছে না| ইথিকস আর লজিকের ভাঁজে ভাঁজে মিইয়ে যাচ্ছে উদ্গিরণ| গলিত লাভা খানিক গড়িয়ে জমাট বাঁধছে| অনুর্বর চিন্তাজগতে বিলি কাটছে আপোষের উকুন| আগুনে পুড়ে কয়লা হওয়া মানুষ আর ট্রাক বোঝাই বোবা গরুর মৃত দেহের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে নির্মোহ বিদ্রপ- এরই নাম কি গণতন্ত্র? ব্যাস! তারুণের পৌরুষ বার কয়েকবার লম্ফঝম্ফ করে ৬ টাকার লাল চা-য়ে শেষ হচ্ছে|
কেন?
মাত্র পনের-কুড়ি বছর আগেই যে আশঙ্কার কথা জানা গেছিল তবে কি সেটাই অঙ্কুরিত হয়ে বট বৃক্ষ হল?
তবে কি সবই সেই ‘শক্’ এর খেল? মাত্র দুই দশকে তিনটি প্রজন্ম ব্রয়লার হয়ে গেল!
“মানুষ মাঝে-মধ্যেই সব ছেড়ে ছুড়ে অরণ্যচারি হতে চাইছে| ক্ষণে ক্ষণেই বলে উঠছে, ‘দাও ফিরে সেই অরণ্য’| সায়েন্স ফিকশন আর তুকতাক মন্ত্রতন্ত্রে আবিষ্ট হয়ে নিভৃতচারি হতে চাইছে| মানুষকে এখান থেকে ফেরানোর জন্য পণ্য প্রবাহ আর অভাব বোধের অসীম আকাঙ্খায় ফেরানোর জন্য ধরে ধরে শক্ দেওয়া হচ্ছে| সিনেমায় শক্ দেওয়া হচ্ছে| বীভৎস ছবি ছেপে শক্ দেওয়া হচ্ছে| অরবিটাল ভেরিয়েশনে হরর মুভি, হরর উপন্যাস, স্যাডিস্ট গল্প, রেপিস্ট সিনড্রোম গিলিয়ে শক্ দেওয়া হচ্ছে| ট্রাডিশনাল শিল্পকর্ম এখন শক্, শকুমেন্টারি| তিনটি ‘এস’ দিয়ে তাদের বিবশ করে দেওয়া হচ্ছে| এস ফর সেক্স| এস ফর স্যাডিজম| এস ফর শক্| ফলে মানুষের চিরাচরিত ভাবাবেগ, বিচারবুদ্ধি, বিবেক, দর্শন সব শকোথেরাপিতে স্যাডিজমে রূপান্তরিত হচ্ছে| এর নির্বিকার প্রদর্শনে দ্রোহী মানুষ নিজেকে হাজির করছে সার্কাসের ক্লাউনরূপে?”
[“শকুমেন্টারি শকোথেরাপি এবং কর্পোরেট ডেমোক্র্যাসি”- মনজুরুল হক। ‘পাঠসূত্র’]
২৬ মার্চ, ২০০৪ সাল। তৈরী হলো র্যাব (র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন)| নিখুঁত ‘ক্রসফায়ার’| মোটা দাগে ভাগ হয়ে গেছিল বাংলাদেশের বিপ্লবাকাঙ্কা আর সর্বগ্রাসী আপোষে| সেল্ফ সেন্সরশিপে| এরও পরে এসেছিল তথ্য প্রযুক্তি আইনের কুখ্যাত ৫৭ ধারা| তাতে কোনো জামিন নেই। তারও পরে একটু ‘নমনীয়’ করে আনা হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বহুল আলোচিত ৩২ ধারাসহ চারটি ধারা| যা নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে দশটি দেশ| ইউরোপীয় ইউনিয়নও তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছে | তাতে কার কি আসে-যায়?
ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছাড়া যে দেশগুলো প্রস্তাবিত আইনের কিছু ধারা নিয়ে আপত্তি তুলেছে, সেগুলো হলো: যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, কানাডা, জার্মানি, সুইডেন, ডেনমার্ক, স্পেন, নরওয়ে ও সুইজারল্যান্ড| তাতেই বা সরকারের কী আসে -যায়?
২১, ২৫, ২৮ ধারায় যা আছে তা তো চরম নিবর্তনমূলক আছেই সেই সাথে ৩২ ধারায় বলা আছে, “যদি কোনো ব্যক্তি বেআইনি প্রবেশের মাধ্যমে কোনো সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের অতি গোপনীয় বা গোপনীয় তথ্য ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ধারণ, প্রেরণ ও সংরক্ষণ করেন বা সহায়তা করেন, তাহলে সর্ব্বোচ ১৪ বছরের সাজা। ২৫ লাখ টাকা জরিমানা| দ্বিতীয়বার একই অপরাধ করলে কারাদণ্ডের পাশাপাশি জরিমানা হবে কোটি টাকা”|
২০০৬ সালে বিএনপি সরকারের আমলে করা করা তথ্য প্রযুক্তি আইনটি ২০০৯ এবং ২০১৩ সালের পর নানা টালবাহানা শেষে অবশেষে এখন ৫৭ এবং ৩২ দুটি ধারা দিয়েই দেশের সাধারণ মানুষের মুখ চিরতরে বন্ধ হয়েছে|
সেই বন্ধ মুখে এখন কয়েকটি কমন শব্দ খেলা করে- ‘সহমত’| ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী’| ‘মুচলেকা’| ‘আর এমন কাজ করব না’| ‘জ্বি স্যার’| ‘হ্যাঁ স্যার’| ‘আপ মাই-বাপ’| ‘আমাদের বক্তব্য ভুলভাবে প্রকাশ হয়েছে স্যার’|
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অধিকৃত পোল্যান্ডের ইহুদীদের জামার হাতায় হলুদ রঙের ব্যাজ পরিয়ে দেয়া হতো| যাতে করে তাদের আলাদা করা যায়| পথে-ঘাটে যেন তারা ঘৃণার পাত্র হয়ে ওঠে| সেই ঘৃণ্য ব্যবস্থার চেয়ে এই ৫৭ এবং ৩২ ধারার ‘উন্নয়ন রেজিম’ শ্রেয় এ কথা বলা ছাড়া মেরুদণ্ডহীন ইন্টেলেকচ্যুয়ালদের আর যেটা করণীয় দেখা যায় তা হলো সকালে ঘুম থেকে উঠে বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে বিদ্যা-বুদ্ধি নিয়ে বসে থাকা- কখন সরকারী লোক বা ক্ষমাবানরা কিনতে আসবে! এবং জলের দামে নিজেকে বিক্রি করতে পেরে জাতে উঠতে পারবে|
এখন আমি বুঝতে পারি- কানু সান্যাল কেন আত্মহত্যা করেছিল?