মাথায় তেল দিয়ে তেড়ি কেটে মুখে পান ঠোঁটে সিগারেট ফুকতে ফুকতে যখন ভোটটা দিতে গেছিলেন তখন এই সহজ-সরল কৃষকরা জানতেন না গড়ে ৫০৩ টাকা খরচ করে প্রতি মণ ধান উৎপাদন করে তা ৩৮০ টাকা বিক্রি করতে হবে! এবার খাতওয়ারি হিসেব করলে দেখা যাবে এক একর জমিতে ধান উৎপাদন করে কৃষককে লোকসান গুনতে হচ্ছে ৬ হাজার ৯২০ টাকা!
এই ঘটনা তো এবারই প্রথম না! প্রতি বছর নিয়ম করে হয়ে আসছে। কেন হচ্ছে সে ব্যাপারে সরকারসংশ্লিষ্টরা জানেন না সে কথা দুধের শিশুও বিশ্বাস করবে না। এই অন্যায়-অবিচার, নিপীড়ন-শোষণ দেখার জন্য একাধিক মন্ত্রণালয় রয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সকলেই জানেন। তারা প্রতি বছর চরম তামাশাপূর্ণ একটা বিবৃতিও দেন, অনেকটা এরকম- ‘এবার সরকার সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান-চাল সংগ্রহ করবে’।
এই ‘ঐতিহাসিক’ বাণী কার্যকর করবার জন্য কোথাও কোথাও নাম কা ওয়াস্তে কেনা শুরু করে আবার বন্ধ করে দেয়। কেন দেয়? কারণ তাহলে আরও যে ডজনখানে মধ্যস্বত্ত্বভোগী দালাল এবং তস্য দালাল রয়েছে তাদের ইনকাম কমে যাবে। তারা পরের বার ভোটের সময় মোটা অংকের চাঁদা দেবে না।
লেকচারটা মারবার সময় বলা হবে; ‘জনগণের দোর গোঁড়ায় উন্নয়নের সুফল পৌঁছে দেওয়া হবে’ এবং নিরুপায় অসহায় জনগণ সেই চপাবাজী ধাপ্পাবাজী বিশ্বাস করতে বাধ্য হবে। মিলার, সাইলো মালিক, মিল মালিকদের সিন্ডিকেট, সরকারের বিভিন্ন এজেন্ট, স্থানীয় রাজনৈতিক পাণ্ডা, মাস্তান, কোমল জায়গার আত্মিয়, ভবিষ্যতের ক্যাডার, সরকারী আমলা, সেই আমলাদের সূতোয় সূতোয় গিঁট দেওয়া আত্মিয়-স্বজন সকলের হিস্যার কথা সরকারকে মাথায় রাখতে হয়। আর সেই হিস্যা নিশ্চিত করবার জন্য ওইসকল মধ্যস্বত্ত্বভোগী হায়নাদের সামনে ফেল দেওয়া হয় কৃষককে। কৃষক মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রক্ত পানি করে নিজের সন্তানের মত যে ফসল উৎপাদন করল তা তাকে নিঃস্ব করে দিল। দেনাদার করে দিল!
আর এই করুণ দৃশ্যাবলী ঘটনাবলী, সংবাদ, প্রতিবেদন দেখার পরও , জানার পরও এই বিষয়গুলো দেখভাল করার জন্য লাখ লাখ টাকা বেতনভোগী মন্ত্রি, আমলা, কর্মকর্তা, কর্মচারী, কেরানী-চাপরাশীরা নির্বিকার সেমিনার-সিম্পোজিয়াম করতে থাকে আর সে সবের সচিত্র প্রতিবেদন পত্রিকায় ছাপা হতে থাকে। দেশ-বিদেশে ইংরেজি ভার্সন বিলি হতে থাকে। অথচ সামান্যতম লজ্জা-শরম থাকলে এদের মুখে ভাত যাওয়ার কথা নয়। বমি হয়ে যাবার কথা। উল্টি হবার কথা! যে সব ইতররা বসে বসে প্রতি বছরই এই সব করুণ দৃশ্য দেখে, বিব্রতকর সংবাদ পড়ে সেই ইতরদের অনেকেরই বাবা-চাচারা এভাবেই লোকসান দিয়ে ফসল ফলিয়ে এদের লেখাপড়া শিখিয়ে এই রকম শীর্ষ অবস্থানে বসার সুযোগ করে দিয়েছে!
এই হিসেবটা দেখুন। ঘেন্নায় গা রি রি করে উঠবে। অথবা মনে হবে ভাত খাব না। কিংবা বমি করে দিই! এখানে শুধু টাকার অংক আছে। তার সাথে চারা বানানো, জমি বানানো থেকে শুরু করে বস্তাবোঝাই হয়ে হাটে ওঠার মধ্যে একজন কৃষককে কতটা পরিশ্রম করতে হয়, কত কেজি ঘাম ঝরাতে হয় তা কিছুটা জানেন যারা এখনও গ্রামে থাকেন। কিন্তু এই শহুরে সায়েবরা স্যাটেলাইটের খোঁজ জানলেও এসবের কোনো খোঁজ রাখেন না।
“আমনের শুরুতে প্রতি মণ (২৮ কেজি) ধান বিক্রি হয়েছে ৫২০ টাকায়। দাম কমতে কমতে বর্তমানে সেই ধান প্রতি মণ বিক্রি হচ্ছে ৩৮০ টাকায়। মণপ্রতি ধান উৎপাদনে তাঁদের উৎপাদন খরচ পড়েছে গড়ে প্রায় ৫০০ টাকা।
দুটি কারণের একটি হচ্ছে আমনে উৎপাদন ও হঠাৎ আমদানি বেশি। অন্যটি হচ্ছে বাজার পড়ে যাওয়ায় চালকলগুলো ধান কিনছে না। আমনের বাজারদর এখন ৩৮০ টাকা
আমনে এক একর জমি ট্রাক্টর দিয়ে চাষ করতে খরচ ৩ হাজার ২০০ টাকা, ধান রোপণ করতে শ্রমিকের মজুরি ৩ হাজার টাকা, ধানবীজ ১ হাজার ৬০০ টাকা, রাসায়নিক সার ২ হাজার ৭০০ টাকা, নিড়ানি খরচ ৪ হাজার টাকা, কীটনাশক ২ হাজার ৫০০ টাকা, সেচ খরচ ৩ হাজার টাকা, কাটা-মাড়াইয়ে খরচ ৮ হাজার ২০০ টাকা। সব মিলিয়ে এক একরে খরচ হয়েছে ২৮ হাজার ২০০ টাকা। তিনি এক একরে ধান পেয়েছেন ৫৬ মণ (২৮ কেজিতে মণ)। প্রতি মণ ধানে উৎপাদন খরচ পড়েছে ৫০৩ টাকা। বর্তমানে প্রতি মণ ধানের বাজারদর ৩৮০ টাকা হিসেবে ৫৬ মণ ধানের দাম হয় ২১ হাজার ২৮০ টাকা। অর্থাৎ প্রতি একরে আমন চাষে কৃষককে লোকসান গুনতে হচ্ছে ৬ হাজার ৯২০ টাকা (প্রথম আলো, ৪ মার্চ, ২০১৯)”
এর পর কি? কিসসু না। অন্য অনেক কিছুর মত এই ভয়াবহ ঘটনাগুলোও সবাই ভুলে যাবে। ভুলে যাবে কোথাকার কোন কৃষক মনের কষ্টে ধানে আগুন দিয়েছিল। ভুলে যাবে কোন কৃষক ঘটি-বাটি বন্ধক রেখে উৎপাদন অব্যহত রেখেছিল। ভুলে যাবে কোন কৃষক দাদনের টাকা শোধ দিতে না পেরে আত্মহত্যা করেছিল।
মধ্যস্বত্ত্বভোগী চিনে জোঁক সব দেশে সব সমাজে থাকে, কিন্তু বাংলাদেশের মত এমন নিলজ্জ ইতর মধ্যস্বত্ত্বভোগী ভোগী আর স্টুপিড কর্মকর্তা-অধিকর্তা আর কোনো দেশে আছে বলে মনে হয় না। এত বড় নির্লজ্জ এতবড় এস্কেপিস্ট হিপোক্র্যাট বাংলাদেশি প্যারাসাইট ইতর ছাড়া আর কে হতে পারে। এভাবে সরকারী আনুকল্য পেয়ে শয়তানীর চরম পারাকাষ্ঠা আর কারা দেখাতে পারে?
৯, মে, ২০১৯