আজ ১৪ মে কমরেড চারু মজুমদারের জন্মদিন। ১৯১৭ সালের এই দিনে তিনি ভারতের বারানসীতে জন্মগ্রহণ করেন। এই মহান কমিউনিস্ট নেতার আদর্শ নিয়ে কাটা-ছেড়া, ঘসা-মাজা, গ্রহণ-বর্জনের মত তাঁর জন্মদিন নিয়েও ধন্ধ তৈরি হয়েছে। ভারতে সিপিআই (এম-এল) লিবারেশন, যে পার্টিতে তাঁর ছেলেই একজন নেতা, সেই পার্টি পালন করছে ১৪ মে, ১৯১৯! বাংলাদেশে চারু মজুমদারের যে রচনা সংকলন আছে সেখানে বলা হয়েছে; ১২মে, ১৯১৭! আন্তর্জাতিক সার্চ ইঞ্জিনে বলা হচ্ছেঃ Charu Majumdar, Born: 12 March 1918, Siliguri, Bengal Presidency, British India.
Wikidita: জানাচ্ছে- 12 March 1918 Gregorian ক্যালেন্ডার মতে। অথচ জন্মদিন হিসাবে পালিত হচ্ছে ১৪ মে, ১৯১৯ (বাংলাদেশে ১৯১৭)!
যে মানুষটি কার্ডিয়াক অ্যাজমা নিয়ে প্রায়শই মুখ দিয়ে রক্তক্ষরণ হওয়া অবস্থায় অক্সিজেন সিলিন্ডার ও পেথিড্রিন ইঞ্জেকশনসহ দু:সহ আন্ডারগ্রাউন্ড জীবন কাটিয়েছেন ৩৯টি বছর!
এই ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্বের বিভিন্ন দিকগুলো আলোচনা আমাদের সাধ্যের মধ্যেই সীমিত। টলস্টয়ের কথায় ‘জীবন শিল্পের চেয়ে মহান’। এতবড় মাপের মানুষ , যিনি একটা ঐতিহাসিক সময়কে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন, তাঁকে সামগ্রিক উপলব্ধি নিয়ে অনুধাবন করতে গেলে যে দক্ষতা ও সময় প্রয়োজন ছিল তার অধিকারী আমরা নই। আর তাঁকে জানা মানেই তাঁর দুর্দমনীয় স্পিরিট ও প্রাসঙ্গিকতা বোঝা।
ভারতবর্ষে কমিউনিস্ট পার্টি জন্মের পর থেকে এই অঞ্চলে সামন্ত, বুর্জোয়া, ধর্মাশ্রয়ী শাসকশ্রেণির অনিঃশেষ শোষণ থেকে মানুষকে মুক্ত করা যায়নি। প্রবল পরাক্রমশালী ব্রিটিশরাজ খেদাতে পারলেও ভারতবাসী স্বজাতির লুটেরা-শোষক-নিপীড়কদের হঠাতে পারেনি।
একজনই শুধু পেরেছিলেন সাময়ীক সময়ের জন্য। তিনিই সর্বপ্রথম ভারতবর্ষের আজন্ম নিপীড়িত-শোষিত ভূমিহীন কৃষককে জমির মালিকানার স্বাদ দিয়েছিলেন। কিছু সময়ের জন্য পশ্চিবঙ্গের কিছু অঞ্চলের ভূমিহীনরা ভূমির মালিকানা পেয়েছিল। নিজ ভূমিতে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে মানুষটির জন্য, তিনি চারু মজুমদার। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (এম-এল) এর প্রতিষ্ঠাতা। নেতা-কর্মীরা যাকে আপন করে ‘চারুদা’ বলে ডাকতেন। এত বছর পরও যিনি ভারতের তথা এই অঞ্চলের কমিউনিস্ট বিপ্লবের অথোরিটি।
উপমহাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের আর এমন একজন শীর্ষস্থানীয় নেতার নাম করা যাবে না যিনি শত্রুর হাতে বিপ্লবের জন্য, মানুষের মুক্তির জন্য প্রাণ দিয়েছেন। মুজফ্ফর আহমেদ নন, ডাঙ্গে, রণদিভে, অজয় ঘোষ, রাজেশ্বর রাও, নাম্বুদ্রিপাদ কেউই নন। চারু মজুমদারই ছিলেন প্রথম শীর্ষস্থানীয় একজন নেতা যিনি খোদ পুলিশ প্রসাশনের হেড কোয়ার্টার্সেই প্রাণ দিয়েছেন ২৮ শে জুলাই ১৯৭২ সালে। ধরা পড়ার মাত্র এগার দিনের মাথায়। মারা যাওয়ার সময় তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র ৫৪ বছর।
জন্মবার্ষিকীর স্মরণে মৃত্যুর বর্ণনা একটু বেখাপ্পা মনে হলেও বলা দরকার- খুন, ডাকাতি, রাহাজানি, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র–এই সব অভিযোগে তাঁকে গ্রেপ্তার করে লালবাজার লকআপের পাশের ঘরে সাংবাদিকদের সামনে আনা হয় তখন তাঁকে বেশ প্রফুল্লই লাগছিল। এতটুকু বিচলিত দেখায়নি। এক শার্ট আর সাদা পাজামা পরে হাসি হাসি মুখে ফটোগ্রাফারদের কিছুটা সময় দিয়েছেন। হার্ট স্পেশালিস্টও ইজিসি রিপোর্ট দেখে বলেছেন, অসুস্থ, তবে খারাপ আশঙ্কা করার কিছু নেই। তবুও এটা কি করে হলো? তাঁকে ধরিয়ে দেবার জন্য ১০,০০০ টাকা পুরষ্কার ঘোষণা করেছিল সিদ্ধার্থবাবুর সরকার। একই অঙ্ক ঘোষণা করেছিল অন্ধ্র, বিহার উড়িষ্যার সরকারও।
যেদিন পুলিশ হানা দিয়ে তাঁকে ধরে তারপর সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ কমিশনার ফোনে মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থবাবুকে জানান। সিদ্ধার্থবাবু হান্টিং কলে দিল্লিতে ইন্দিরা গান্ধীকে জানান। আকাশবাণীর প্রতিটি কেন্দ্রে খবর ঘোষণা করা হয়। সেই মানুষটা আজ আর নেই। চারু মজুমদারকে গ্রেপ্তারের সময় আর দু‘জন যাঁরা ছিলেন তারা শ্লোগান দিয়ে কালো ভ্যানের সামনে অত রাতে জমায়েত লোকের সামনে বলে ওঠেন, ‘কমরেডস, আমাদের সঙ্গে এই বয়স্ক মানুষটাই হলেন চারু মজুমদার। পুলিশ এঁকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে।’ সমস্ত জনতাই পলকের জন্য থমকে উঠলো। নকশালবাড়ির সুবাদে এই নামের সঙ্গে পরিচিত সবাই। তাঁকে ঘিরে গড়ে উঠেছে এক রোমান্টিক নেতার চরিত্র। একজন বয়স্কা মহিলা বলে উঠলেন, ‘আহা, এমন একজন মানুষ আমাদের পাড়ায় ছিলেন! আগে জানলে একটু চোখের দেখা দেখে নিতাম।’
‘কিপ এলারর্ট। চারু মজুমদারে ইজ ডেড। উই মাস্ট বি অন দ্য ওফনেসিভ।’ অয়্যারলেসের মাধ্যমে গোটা পশ্চিম বাংলার থানায় ঘন ঘন মেজেস ছড়িয়ে যেতে থাকে।
বসন্তের বজ্র নির্ঘোষ খ্যাত মহান নকশালবাড়ি কৃষক সংগ্রামের রূপকার, সংশোধোনবাদী-নয়াসংশোধোনবাদীদের কবর রচনাকারী এবং শ্রেণীসংগ্রামের উচ্চতর রূপের প্রবক্তা ও প্রয়োগবিদ এবং ভারতবর্ষের বিপ্লবের অথোরিটি মহান নেতা কমরেড চারু মজুমদার লাল সালাম।
মনজুরুল হক
১৪মে, ২০১৯