বাংলার সাহিত্য, সুকুমারবৃত্তি, শিল্প সবখানেই একটা গোপন সত্য লুকিয়ে থাকে। সেই ‘কল্লোল যুগ’ থেকে গণসাহিত্য গণঅভ্যুত্থানের সাহিত্য হয়ে আজকের বাজারি সাহিত্য নিয়ে আলেচনার শুরুতেই চোখ বন্ধ করে বলে দেয়া চলে ‘তাঁর পূর্ব পুরুষ পূর্ববাংলা থেকে আগত’। কেন? কারণ দেশ ছাড়ার নাড়িছেড়া ব্যথা তাঁর চে’ বেশি করে কে অনুভব করে? মনিক বন্দোপাধ্যায়ও তার ব্যতিক্রম নন।
যদিও তাঁর জন্ম ১৯০৮ সালের ১৯মে ভারতের অধূনা নতুন রাজ্য হওয়া ‘ঝাড়খণ্ড’-র সাঁওতাল পরগনার দুমকা শহরে। পৈত্রিক নিবাস পূর্ববঙ্গের বিক্রমপুরের গাউদিয়া গ্রামে, এবং পরবর্তীতে এই গ্রামের পটভূমিতে তিনি রচনা করেন ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’।
চার ভাইবোনের পর জন্ম হল ঘুটঘুটে এক কালো ছেলের। অমন গায়ের রং দেখে আঁতুড় ঘরেই নাম দেওয়া হল কালোমানিক। ঠিকুজিতে নাম রাখা হল অধরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই নামে কেউ কোনও দিনও ডাকল না। এমনকী বাবা হরিহর সাধ করে ছেলের নাম রাখলেন প্রবোধকুমার। সেই নামও আড়ালেই থেকে গেল। ভালবেসে কালোমানিক বলেই ডাকত সকলে। বয়স বাড়তে কালোমানিক থেকে কালো গেল খসে। পড়ে রইল শুধু মানিক। ওই নামেই জীবনের প্রথম গল্প ‘অতসী মামী’ ছাপা হয়েছিল। সারা বিশ্বের বিরল প্রতিভাধারীদের মত তিনিও পঞ্চাশ পার হওয়ার আগেই শেষ! তাকেও মাত্র ৪৮ বছর পর পৃথিবীর মায়া কাটাতে হয়!
গণিতে অনার্স নিয়ে ভর্তি হয়েছেন কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে। একদিন কলেজ ক্যান্টিনে বন্ধুদের সঙ্গে তুমুল তর্ক। এক বন্ধুর লেখা গল্প কোনও একটি নাম করা পত্রিকা থেকে অমমোনীত হয়ে ফেরত এসেছে। সেই বন্ধু মহা খাপ্পা হয়ে বলল, বড় পত্রিকাগুলি নামী লেখকদের লেখা ছাড়া ছাপায় না।
সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করে উঠলেন মানিক।— ‘এটা হতেই পারে না। তুমি ভুল বলছ। তোমার গল্প ভাল হয়নি বলেই তারা ছাপেনি। পছন্দ হলে নিশ্চয়ই ছাপত।‘
বন্ধুও পাল্টা নিলেন, ‘প্রমাণ করে দেখাতে পারবে?’
‘বেশ, আমি আগামী তিন মাসের মধ্যে একটা গল্প লিখে কোনও নামী পত্রিকায় ছাপিয়ে দেখাব।‘
তিন মাস নয়, তিনদিনের মধ্যে একটা গল্প লিখে ফেললেন। গল্পকারের নাম প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় লিখতে গিয়েও থমকালেন।
জীবনের প্রথম গল্প। সম্পাদকের পছন্দ হবেই সে বিষয়ে নিশ্চিত। কিন্তু বারো তেরো বছর বয়সের মধ্যেই বাংলার সেরা সাহিত্যগুলো যার পড়া হয়ে গেছে সেই মানিক কিন্তু বুঝেছিলেন ‘অতসী মামী’ আসলে ‘অবাস্তব রোম্যান্টিকতায় ভরা’।
সেই সংকোচেই প্রবোধকুমারের বদলে লিখলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। তারপর সেই গল্প নিয়ে নিজেই সটান হাজির ‘বিচিত্রা’ পত্রিকার দফতরে।
সম্পাদক উপেন্দ্রনাথ সেই সময় দফতরে ছিলেন না। তার জায়গায় বসেছিলেন আরেক দিকপাল সাহিত্যিক অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত। স্মৃতিকথায় অচিন্ত্যকুমার লিখছেন, ‘একদিন বিচিত্রার দফতরে কালোপানা একটি লম্বা ছেলে এল। বলল গল্প এনেছি। বললাম, দিয়ে যান। সেই ছেলে লম্বা হাত বাড়িয়ে গল্পের পাণ্ডুলিপি দিয়ে বলল, এই যে রাখুন। এমন ভাব যেন এখুনি ছাপতে দিয়ে দিলে ভাল হয়। চোখে মুখে আত্মবিশ্বাস চুঁইয়ে পড়ছে। গল্প জমা দিয়ে সে চলে গেল। আমি তারপর এমনিই গল্পে একবার চোখ বোলাতে গিয়ে চমকে উঠলাম। এ যে রীতিমতো দুর্দান্ত গল্প!’
সেই গল্প প্রকাশ তো পেলই, বাংলার পাঠকমহলেও হইহই পড়ে গেল। বিচিত্রার সম্পাদক খোঁজখবর নিয়ে ছুটে এলেন মানিকের সঙ্গে দেখা করতে। লেখার সাম্মানিক কুড়িটা টাকা হাতে দিয়ে অনুরোধ করলেন, ‘আপনি আবার গল্প দিন আমাদের।‘
ইচ্ছে ছিল ত্রিশ বছরের আগে কোনও দিন গল্প লিখবেন না, কিন্তু কুড়ি বছর বয়েসেই বাজি রেখে গল্প লিখে এমনই বিখ্যাত হয়ে গেলেন যে সেদিন আবার গল্প লিখতে রাজি হতে হল, আর সেদিনই ঠিক হয়ে গিয়েছিল মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিয়তি।
এবার আমরা সটান তার দস্যিপনা এবং শৈশবের ঘটনাগুলো থেকে দুএকটা উল্লেখ করে
ওভারল্যাপ করব।
মানিক এমন দস্যি ছিলেন যে হাঁটতে শিখেই বাড়ির আঁশবটিতে নিজের পেট কেটে প্রায় দুই ফালা করে ফেলেছিলেন।
ডাক্তারবাবু সেলাই করলেন। সেই সেলাই নিয়েই পরদিন ওই হাসপাতালেই দাপাদাপি শুরু। দস্যিপনার সঙ্গে ছিল এক উদ্ভট স্বভাব।
একবারের ঘটনা। সবার অলক্ষ্যে উনুন থেকে চিমটে দিয়ে জ্বলন্ত কয়লা তুলে খেলতে গিয়ে সেই কয়লা পড়ল পায়ের গোড়ালির পাশে। ব্যস, কালোয়াতি গান শুরু। কেউই বুঝতে পারে না আসলে কী হয়েছে।
তারপর মাংস পোড়ার গন্ধ পেয়ে সকলে ঘর থেকে ছুটে বাইরে বেরিয়ে এসে দেখে চোখের জলে গলা বুক ভেসে যাচ্ছে মানিকের, কিন্তু গলায় গান আর পায়ে গর্ত হয়ে গেঁথে যাওয়া গনগনে কয়লার টুকরো। সেই এক ইঞ্চি পোড়া দাগ আর জীবনে ওঠেনি।
আরেকবার। মানিক তখন ক্লাস সেভেন। ম্যালেরিয়ায় কাবু। স্কুল যাওয়া বন্ধ।
এদিকে কালীপুজোর বাকি আর কয়েকদিন। বাড়ি বসে কী করা যায়? মাথায় বুদ্ধি এল পটকা বানালে হয়।
ভাবামাত্র ছোট দুই ভাইকে নিয়ে কাজ শুরু। ন্যাকড়ার ফালিতে পাথরকুচি পেঁচিয়ে বাঁধছে মানিক। পাশে কাচের শিশিতে রাখা বারুদ। দাদার পিছনে বসা এক ভাইয়ের কৌতূহল হল বারুদ কেমন ভাবে জ্বলে তা দেখার।
মেঝেতে কিছুটা বারুদ ঢেলে দেশলাই কাঠি জ্বালিয়ে ছোঁওয়ানো মাত্রই ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ।
কাঁচের শিশি ফেটে তার কুঁচি তিন ভাইয়ের গোটা শরীরে।
ধোঁয়া কাটার পর দেখা গেল তিন ভাই বারান্দায় শুয়ে ছটফট করছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে বারান্দা। সঙ্গে সঙ্গে তিনজনকেই নিয়ে যাওয়া হল ডাক্তারখানায়।
পরীক্ষায় বরাবর ভাল রেজাল্ট। কিন্তু কলেজে পড়ার সময়েই জড়িয়ে পড়লেন সক্রিয় বাম রাজনীতিতে।
তার সঙ্গে দিনরাত সাহিত্য চর্চা। কলেজের লেখাপড়া শিকেয়। ফলে বিএসসি-তে পরপর দু’বার ফেল।
তখন পড়াশোনার যাবতীয় খরচ চালাতেন বড়দা। ভাইয়ের রাজনীতি করার খবর পেয়ে চিঠিতে লিখলেন, “তোমাকে ওখানে পড়াশোনা করতে পাঠানো হয়েছে, ফেল কেন করেছ, তার কৈফিয়ত দাও।”
উত্তরে মানিক লিখলেন, গল্প উপন্যাস পড়া, লেখা এবং রাজনীতি ছেড়ে দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়।
প্রচণ্ড রেগে গিয়ে দাদা বললেন, “তোমার সাহিত্য চর্চার জন্য খরচ পাঠানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়।” টাকা পাঠানো বন্ধ করে দিলেন দাদা।
উত্তরে মানিক লিখলেন, ‘‘আপনি দেখে নেবেন, কালে কালে লেখার মাধ্যমেই আমি বাংলার লেখকদের মধ্যে প্রথম শ্রেণিতে স্থান করে নেব। রবীন্দ্রনাথ- শরৎচন্দ্রের সমপর্যায়ে আমার নাম ঘোষিত হবে।”
ষোলো বছর বয়েসে মাকে হারানোর পর এমনিই জীবন হয়ে উঠেছিল ছন্নছাড়া, এবার দাদা টাকা পাঠানো বন্ধ করে দেওয়ায় শুরু হল প্রকৃত দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই।
চলে এলেন আমহার্স্ট স্ট্রিটের একটি মেসে। বাবা রইলেন মুঙ্গেরে ছোটভাই সুবোধের কাছে।
দিনরাত এক করে নাওয়া খাওয়া ভুলে তখন মানিক শুধু লিখছেন, প্রকাশকদের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন।
নিজের শরীরের কথা ভুলে এই ভাবে অমানুষিক পরিশ্রমের ফলও ফলল কিছু দিন পরেই।
এক সময় কুস্তি লড়া, একা হাতে দশজনের সঙ্গে মোকাবিলা করা মানিক ভেঙে যেতে থাকলেন।
১৯৩৩ সালে কলকাতায় এসেছিল এক বিখ্যাত পুতুল নাচের দল। সেই কার্নিভালের নাচ দেখে এমনই মুগ্ধ হলেন যে সেই পুতুলদের সঙ্গে মানুষের জীবনকে মিলিয়ে লিখতে শুরু করলেন ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’।
সেই উপন্যাস লিখতে বসে নিজের কথাই যেন ভুলে গেলেন মানিক।
আক্রান্ত হলেন দূরারোগ্য মৃগীরোগে। শরীর আর দিচ্ছে না। তার মধ্যেই দাঁতে দাঁত চেপে চলছে লড়াই। নিজের রোগের সঙ্গে, চরম দারিদ্রের সঙ্গে।
এই রোগের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতেই শুরু করলেন অপরিমিত মদ্যপান।
এর মধ্যেই চিকিৎসক বিধান রায়ের পরামর্শে বিয়ে করেছেন, ছেলে–মেয়ে হয়েছে। বাবাকে নিয়ে এসেছেন নিজের কাছে।
বরানগরে গোপাললাল ঠাকুর স্ট্রিটে সকলে মিলে ঠাসাঠাসি করে কোনওমতে থাকা।
তার মধ্যেই চলে একের পর এক যুগান্তকারী রচনা। এত লেখালেখি করেও সংসার যেন আর চলে না। বাধ্য হলেন চাকরি নিতে। কিন্তু কিছু দিন পরেই সে চাকরিতে ইস্তফা।
আবার পুরোদমে লেখা শুরু, সঙ্গে দারিদ্র। সে দারিদ্র যে কী ভয়ংকর তা জানা যায় মানিকের ডায়েরির একটি পৃষ্ঠা পড়লে। স্ত্রী ডলি অর্থাৎ কমলা এক মৃত সন্তানপ্রসব করেছেন, আর মানিক ডায়েরিতে লিখছেন, “বাচ্চা মরে যাওয়ায় ডলি অখুশি নয়। অনেক হাঙ্গামা থেকে বেঁচেছে। বলল, বাঁচা গেছে বাবা, আমি হিসেব করেছি বাড়ি ফিরে মাসখানেক বিশ্রাম করে রাঁধুনি বিদায় দেব। অনেক খরচ বাঁচবে।”
দারিদ্র কী অপরিসীম হলে মায়ের মুখ থেকে এমন কথা বেরিয়ে আসে!
সংসারের এমন অবস্থায় আবার ঠিক করলেন চাকরি করতে হবে। ‘বঙ্গশ্রী’ পত্রিকায় সাপ্তাহিক বিভাগের জন্য সহকারী সম্পাদক প্রয়োজন। মানিক আবেদন করলেন।
জানতেন ওই পদের জন্যই আবেদন করবেন আরেক সাহিত্যিক পরিমল গোস্বামী। তাই নিজের আবেদনপত্রের শেষে সম্পাদককে লিখলেন, ‘‘আমি অবগত আছি শ্রীপরিমল গোস্বামী এই পদটির জন্য আবেদন করিবেন। আমার চেয়েও তাঁহার চাকুরির প্রয়োজন বেশি। মহাশয় যদি ইতিমধ্যে তাহার সম্পর্কে অনুকূল বিবেচনা করিয়া থাকেন, তবে অনুগ্রহপূর্বক আমার এই আবেদন প্রত্যাহার করা হইল বলিয়া ধরিয়া লইবেন।’’
চাকরি অবশ্য তারই হল। মাস মাহিনা ৮৫ টাকা। সঙ্গে শর্ত ‘অমৃতস্য পুত্রা’ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করতে হবে। তার জন্য পাবেন আরও ১০ টাকা মাসপ্রতি। কিন্ত ভাগ্যে চাকরি নেই।
সেই চাকরিও ছেড়ে দিলেন কিছু দিন পর। অভাব ছিঁড়েখুঁড়ে খাচ্ছে, তার মধ্যেই লিখে চলেছেন, বামপন্থী ফ্যাসিবিরোধী লেখক শিল্পী সংঘের আন্দোলনে যুক্ত হয়ে কখনও একাই প্রাণের মায়া ছেড়ে একাই ঝাঁপিয়ে পড়ছেন কলকাতার হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা রুখতে।
১৯৫০ সালে যখন কমিউনিস্টদের ওপর নেমে এল চূড়ান্ত সরকারি দমননীতি, তখন বহু পত্রপত্রিকায় মানিকের লেখা ছাপানো বন্ধ করে দেওয়া হল। আরও ভয়ংকর সঙ্কট।
গোটা পরিবারের হাঁ মুখের দিকে তাকিয়ে আর যেন সহ্য হত না কিছু। এক এক সময় ধিক্কার লাগত নিজের প্রতি।
মদ বাড়ছিল আর বাড়ছিল ক্ষয়। মদ ছাড়তে চেষ্টা করেও পেরে উঠছিলেন না। দাদাকে আবার চিঠি লিখলেন, কিছু টাকা ধার চেয়ে। দাদা কানা কড়িও দিল না।
ঘনঘন অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, হাসপাতালে ভর্তি, লিভার নষ্ট হতে থাকা মানিক পুরোপুরি বিপর্যস্ত। তার সঙ্গে চূড়ান্ত অনটন।
একদিন ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় পুজো সংখ্যার লেখা দিতে যাচ্ছেন রাস্তায় দেখা হল অধ্যাপক বন্ধু দেবীপদ ভট্টাচার্যর সঙ্গে।
মানিকের ভেঙে যাওয়া শরীর, মলিন জামাকাপড় দেখে খুব খারাপ লাগল দেবীপদর। জোর করে সে দিন নিয়ে গেলেন নিজের বাড়িতে।
ক্লান্ত মানিককে খেতে দিলেন দেবীপদর মা। বড় তৃপ্তি করে ওই খাবারটুকু খেলেন মানিক।
তারপর………….
যে মানিক একদিন সদর্পে ঘোষণা করেছিলেন আমি শুধু সাহিত্যিকই হব, সেই মানিকই অস্ফুটে বলে উঠলেন, “দেখো, দুটি ডাল-ভাতের সংস্থান না রেখে বাংলাদেশে কেউ যেন সাহিত্য করতে না যায়।“
৩০ নভেম্বর, মানিক আবার জ্ঞান হারালেন। ২ডিসেম্বর, সম্পূর্ণ অচেতন অবস্থায় আবার ভর্তি করা হল নীলরতন হাসপাতালে।
এমন অসুস্থতার খবর পেয়ে ছুটে এলেন কবি, কমরেড সুভাষ মুখোপাধ্যায়। আর একটু পরেই অ্যাম্বুল্যান্সে তোলা হবে মানিককে। এবার আর বাড়ি ফেরানো যাবে ‘পদ্মানদীর মাঝি’কে? তাই নিয়ে সকলেই সংশয়ে।
সুভাষ অনুযোগ করলেন লেখকপত্নীকে, ‘‘বৌদি এমন অবস্থা, আগে টেলিফোন করেননি কেন?’’
ম্লান হেসে কমলা উত্তর দিলেন, ‘‘তাতে যে পাঁচ আনা পয়সা লাগে ভাই।’’
সেটুকুও নেই যে ঘরে!
৩ ডিসেম্বর। ভোর চারটে। পৃথিবীতে একটি নতুন দিন সবে শুরু হচ্ছে তখন, বহু দিন অনন্ত লড়াইয়ের পর নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ল এক আটচল্লিশ বছরের জীবন।
বিকেল চারটের সময় বের হল বিশাল শোকমিছিল। নিমতলা ঘাটের দিকে এগোতে থাকল শববাহী গাড়ি।
শেষ দুই দিনের সবসময়ের সঙ্গী দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় স্মৃতিকথায় লিখছেন ‘‘পালঙ্ক শুদ্ধু ধরাধরি করে যখন ট্রাকে তোলা হয় তখন একটা চোখ খোলা, একটা বন্ধ। শরীরের ওপর রক্তপতাকা বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার ওপরে ফুল। মুখটুকু বাদে সমস্ত শরীরটা ফুলে আর ফুলে ছেয়ে গেছে। উপচে পড়ছে দুপাশে…। মাথা এবং পায়ের কাছে দেশনেতা এবং সাহিত্যিক! সামনে পিছনে, দুইপাশে বহু মানুষ। সর্বস্তরের মানুষ। মোড়ে মোড়ে ভিড়। সিটি কলেজের সামনে মাথার অরণ্য। কিন্তু কাল কেউ ছিল না, কিছু ছিল না…জীবনে এত ফুলও তিনি পাননি।’’
আর বন্ধু সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখলেন—
ফুলগুলো সরিয়ে নাও আমার লাগছে। মালা জমে জমে পাহাড় হয় ফুল জমতে জমতে পাথর। পাথরটা সরিয়ে নাও আমার লাগছে। সেই ফুলের ভারে সেদিন সত্যিই দামি পালঙ্কের একটি পায়ায় চিড় ধরে গিয়েছিল।
মানিকের মাত্র দুটি উদ্ধৃতি এখানে তুলে দেয়া হল।
“কী ক্ষতি মুসলমানের রান্না খাইলে? ডাঙার গ্রামে যারা মাটি ছানিয়া জীবীকা অর্জন করে তাহাদের ধর্মের পার্থক্য থাকে, পদ্মানদীর মাঝিরা সকলে একর্ধমী।“
“সব মানুষের মধ্যে একটি খোকা থাকে যে মনের কবিত্ব, মনের কল্পনা, মনের সৃষ্টিছাড়া অবাস্তবতা, মনের পাগলামীকে লইয়া সময়-অসময়ে এমনিভাবে খেলা করিতে ভালোবাসে।“
এই পুরোটা মানিকের জীবনের একটি ক্ষুদ্র অংশ। এই পরিসরে যদিও তাঁর সাহিত্য, রাজনৈতিক দর্শন হিসেবে মার্কসবাদের চর্চা, কমিউনিস্ট পার্টির হয়ে নিরলস শ্রম দানের বিষয়গুলো তুলে আনা যাবে না। তার জন্য ব্যাপক স্থানের প্রয়োজন। তাই এখানে আমরা খুব সংক্ষিপ্তাকারে তাঁর সাহিত্যের নির্যাসটুকু তুলে ধরার চেষ্টা করব।
মানিকের দেখবার দৃষ্টি ও দৃষ্ট-সত্য ভিন্ন প্রকারের। তিনি অত্যাচারিত শ্রেণির মধ্যে শক্তির ঊন্মেষ লক্ষ্য করেছেন এবং সেই ঊন্সেষকে সাহিত্যে চিত্রিত করেছেন। এ শক্তির একমাত্র উৎস হচ্ছে উৎপীড়িত শ্রেণির চেতনা এবং একতা। আর রয়েছে এই তত্যটি যে, জাগতিক পরিস্থিতিই মানুষের চালক এবং শক্তিদায়ক। অথচ এই মানিকই মার্কসবাদের সহচর্য় পাবার আগে সিগমণ্ড ফ্রয়েড দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। তাঁর ‘প্রাগৈতিহাসিক’ সেই সাক্ষ্য দেয়। মানিক ভাববাদ এবং বস্তুবাদের সংঘাতে মাঝে মাঝে বিব্রত হেয়ছেন, বিচলিত হয়েছেন। আবার পরক্ষণেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, অর্থনীতি মানুষের জীবনের সবচেয়ে শক্তিশালী নিয়ামক।
মানিক অন্য অনেক ঔপন্যাসিকের মত আপোসকামী রাজনীতির পথ বেছে নেননি। তার কাছে দেশের মুক্তি মানে অর্থহীন স্বাধীনতা নয়, যে স্বাধীনতা শুধু অল্প সংখ্যক লোককে স্বস্তি দেবে, সুখ দেবে। তাঁর কাছে চূড়ান্ত মুক্তি মানে শোষণমুক্তি।
মানিক বিশ্বাস করতেন এ সমাজ গড়ে উঠবে মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত শেণির সহায়তায় নয়, বরং শ্রমজীবী শ্রেণি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এবং শ্রেণিচ্যুত মানুষের সাহায্যে। শ্রেণিচ্যুত মানুষরা যে সাধারণ মানুষের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হবে সে ঐক্যের কোনো তুলনা নেই। তিনি বিশ্বাস করতেন বলেই তার ‘জীয়ন্ত’ উপন্যাসের সংগ্রামী কিশোর পাঁচুর উপলব্ধি এরকম-
‘সাধারণ বন্ধুত্ব সুযোগ-সুবিধার ব্যাপার। বিপ্লব বন্ধুত্ব গড়ে অন্যরকম। নতুবা জগতে বিপ্লবী হত কে?’
এই মানিককে নিয়ে তাঁর জন্মদিনের স্মৃতিচারণা এখানে শেষ করলে বড়ই খন্ডিত দেখাবে। অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। তার পরও উপায় নেই। আমাদেরকে এখানেই থামতে হলো।
মনজুরুল হক
২০ মে, ২০১৯
ঋণ ও তথ্যসূত্র:
১। অঞ্জন আচার্যর প্রকাশিতব্য গ্রন্থ- আমি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, কিশোর রচনা সমগ্র,মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়- (সম্পা- সৈয়দ আজিজুল হক)।
২। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় জন্মশতবর্ষ সংখ্যা-উত্তরাধিকার।
৩। সাহিত্য করার আগে-মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়।