পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল-লাল পতাকা) সম্পাদক কমিউনিস্ট বিপ্লবী ডা. মিজানুর রহমান টুটুকে ‘ক্রসফায়ারে’ হত্যা করা হয়েছিল আজকের এই দিনে। কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের হত্যা করে নিঃশ্চিহ্ন করার রাষ্ট্রীয় এজেন্ডা বাস্তবায়ন পষ্ট করে দেয় রাষ্ট্র ভেতরে ভেতরে যে খোকসা হয়ে গেছে এবং যে কোনো সময় ভেঙ্গে পড়তে পারে, আর সেই ভাঙ্গার কাজটা করতে পারে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওবাদী মতাদর্শ আত্মস্থ এবং প্রয়োগ করে শ্রমিক শ্রেণি কর্তৃক রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের সংগ্রামী কমিউনিস্ট বিপ্লবীরা। কমরেড টুটু ওরফে রাকেশ কামাল ছিলেন সেই অগ্রসৈনিক।
২০০৮-এর ২৫ জুলাই ভোরে মিরপুর ৬ নম্বর সেকশনের ডি ব্লকের ৮ নম্বর রোডের একটি বাড়ি থেকে র্যাব সদস্যরা ডা.টুটুকে গ্রেপ্তার করে। তবে সংবাদমাধ্যমের কাছে তথ্যটি গোপন করলেও সংবাদপত্রগুলো তাঁর গ্রেপ্তারের খবর প্রকাশ করে। ২৬ জুলাই সকালে ডা.টুটুর বাড়িতে পুলিশ আসে। পুলিশের কাছ থেকেই টুটুর মা ছেলের গ্রেপ্তারের খবর শুনতে পান। ছেলেকে ‘ক্রসফায়ারের’ হাত থেকে বাঁচানোর জন্য সংবাদ সম্মেলন করে ঝিনাইদহ ডিসি’র কাছে স্মারকলিপি দিতে চেয়ে সরকারের প্রতি অনুরোধ জানান নভেরা খাতুন। কিন্তু মায়ের আর্তির প্রতি সহানুভূতি দেখায়নি বাংলাদেশ রাষ্ট্র। শত শত মানুষ টুটুর মা নভেরা খাতুনের সঙ্গে ডিসির কাছে আবেদন জানায়। রাষ্ট্রের চাকর ডিসি সামান্যতম আইন বা মানবিকতার ধার ধানেননি। ২৭ জুলাই ভোরে রাজশাহীর তানোরে তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন ডা. মিজানুর রহমান টুটু।
এই মৃত্যুসংবাদটি নিয়ে এদেশের পত্র-পত্রিকাগুলো ভিন্ন ভিন্ন ঢঙে খবর পরিবেশন করেছিল। অন্যান্য অনেক মৌলিক সমস্যার মত এদশের প্রচারমাধ্যমেও অন্যতম সমস্যা মার্কসবাদ তথা কমিউনিস্ট রাজনীতি বিষয়ে আধাখ্যাচড়া জ্ঞানের লোকজন দিয়ে রিপোর্ট করানো। যারা এই দায়িত্ব অর্পন করেন এবং যারা সম্পন্ন করেন উভয়েরই কমিউনিস্টদের বিষয়ে আরোপিত এ্যালার্জি আছে। সে কারণে পত্র-পত্রিকায় কমিউনিস্ট বিপ্লবী এবং কমিউনিস্ট রাজনীতির রিপোর্টগুলি নিকৃষ্টতম।
ডা. টুটুর রাজনীতি, উত্থান, মৃত্যু নিয়ে না-জানা লোকজন ভুল করতেই পারেন, কিন্তু ‘দীর্ঘদিনের কমিউনিস্ট’ কি করে ভুল করেন? জনাব নেসার আহমেদ তার ‘ক্রসফায়ার: রাষ্ট্রের রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড’ বইতে টুটুর বিয়ে, সন্তান, স্ত্রীর সাথে বনিবনা না হওয়া, স্ত্রীর এবং তার পরিবার বিষয়ে প্রচুর মনগড়া কথাবার্তা লিখেছেন। আর তার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তো রীতিমত ভজগট পাকিয়েছেন। টুটুর মৃত্যু নিয়ে নির্মোহ বাস্তবানুগ রিপোর্ট করেছিলেন কেবলমাত্র আরিফুজ্জামান তুহীন।
টুটুকে ২৭ জুলাই ভোররাতে হত্যা করার পর বাম তাত্ত্বিক বদরুদ্দীন উমরের নেতৃত্বে ৩০ জুলাই এক সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করা হয়েছিল। এই সম্মেলনে হত্যাকান্ডের নিন্দা এবং জড়িতদের বিচার চাওয়া হয়েছিল। অদ্ভুত ব্যাপার হল জনাব উমর মতাদর্শীকভাবে ডা.টুটু যে মতাদর্শ অনুশীলন করতেন সেই মাওবাদ এবং চারু মজুমদারের লাইনের তীব্র বিরোধীতা করেন। নিয়মিত বিরতীতে কমরেড চারু মজুমদারকে হেয় প্রতিপন্ন করা, তার শিক্ষা-দীক্ষা নিয়ে স্থুল কটাক্ষ করা এবং তিনি (চারু মজুমদার) ভারতবর্ষের বিপ্লবের কী কী ‘ভয়ানক ক্ষতি’ করেছেন তার মনগড়া এবং বানোয়াট গপ্প ফাঁদেন। অথচ সেই অশতিপর মানুষটিই ডা.টুটুর হত্যাকাণ্ডের বিচার চাইলেন। যদিও ওই সাংবাদিক সম্মেলনে সাধারণ শ্রোতা-দর্শকের চেয়ে ‘এজেন্সির’ লোকজনই বেশি ছিল।
কিন্তু আরও পরে এবং আজকে যারা ডা. টুটুর মৃত্যু নিয়ে শোকের ভান করছেন তারা কেউ সে সময় টু শব্দটি করেননি।
বিভিন্ন রঙের ‘মাওবাদী’ তকমা লাগানো দল/সংগঠন ডা.টুটুর বিষয়ে হয় মুখে কুলুপ এঁটে থাকেন, নয়ত তথ্য বিকৃতি করেন। ‘গণমুক্তির গানের দল’ ২০১৫ সালে ১৬ ডিসেম্বর কমরেড মোফাখখার চৌধুরীর মৃত্যুবার্ষিকীতে কমরেড মোফাখখারসহ হত্যাকাণ্ডে নিহত/প্রয়াত অনেক বিপ্লবীর নামোল্লেখ করে, সেখানে বিস্ময়করভাবে ডা. মিজানুর রহমান টুটুর নাম ছিল না। তেমনি প্রকাশ্যে ‘আমরা মাওবাদী’ ঘোষণা দেয়া এবং ‘আমরা কিন্তু ভেতরে ভেতরে মাওবাদী’ বলা লোকজনও ডা. টুটুর মৃত্যু নিয়ে টু শব্দটি করেন না।
কিন্তু এক দশক পরে এসে সামাজিক মাধ্যমে এন্তার লেখার অবসরে কারো কারো কী-বোর্ড দিয়ে গল গল করে টুটুস্তুতি বেরুচ্ছে! কেউ কেউ তাঁকে মহান বলছেন। কেউ কেউ তাঁর আদর্শ বাস্তবায়ন করবেন বলে ধনুর্ভঙ্গ পণ করছেন। এক ভদ্র মহিলা তাঁর জীবনী লিখবেন বলে ন্যাকা ন্যাকা আশাবাদ দেখাচ্ছেন, অথচ ওই ভদ্র মহিলার স্বামীটি (যিনি ডা. টুটুর ক্লাসমেট ছিলেন) নিয়মিত বিরতীতে টুটুর রাজনীতিকে ‘হঠকারী’ ‘বিধ্বংসী’ ‘গণবিরোধী’ এবং গণতন্ত্রের অন্তরায় বলে লম্বা লম্বা স্ট্যাটাস দিচ্ছেন।
এইসব মৌসুমী ন্যাকামো ছাপিয়ে এইসব কথিত কমরেডদের টগবগে মগজে ধরা পড়ছে না ডা.টুটু যে অসমাপ্ত কাজটি করে গিয়েছিলেন (অতীতের সকল আন্দোলন-সংগ্রামের সারসংকলন এবং বন্ধুভাবাপন্ন দলগুলো সঙ্গে ঐক্য প্রচেষ্টা এগিয়ে নেয়া) সেটি কোন তিমিরে রয়ে গেল? কেন টুটু নিহত হবার পর থেকে এদেশে মাওবাদী আদর্শের বিপ্লবী রাজনীতি মুখ থুবড়ে পড়ে রইল।
দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওবাদ বিষয়ে যারা অজ্ঞ তারা আলটপকা মন্তব্য করে বসলে সেটা সেই মাত্রার অপরাধ নয় যে মাত্রার অপরাধ করেন মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাওবাদী দাবীদাররা জেনে-বুঝে, সচেতনভাবে।
সাংবাদিক মহলে ডা, টুটু, কমিউনিজম, মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওবাদ, বিপ্লবী রাজনীতি নিয়ে এতটাই অস্পষ্ট ধারণা নিয়ে লেখালিখি হয় যেন তারা কেবলই মঙ্গল গ্রহ থেকে নেমে এলেন! লেখক, সাংবাদিক, কবি-সাহিত্যিকদের বাইরে এই সোস্যাল মিডিয়াতে ইদানিং বিছানা-বালিশ নিয়ে পড়ে থাকা ‘প্রগতিশীল’, ‘বামপন্থী’, ‘কমিউনিস্ট’, ‘বিপ্লবী’রা বাংলাদেশে বিপ্লবী রাজনীতির আগাপাশতলা নিয়ে কি ভাববেন? তারা তো কার নাতনির ছবি আপলোড হয়েছে, সেখানে গিয়ে ন্যাকা ন্যাকা আলাভোলা কমেন্ট করছেন! বুড়ো হাবড়া স্বামী-স্ত্রীর যুগল ছবিতে লিখছেন- বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক!
যে জাতি তার সূর্যসন্তানের মৃত্যুকে অতিক্রম করে সামনে এগুতে পারে না, নতুন সন্তানের জন্ম দিতে পারে না, তাদের মেকি স্মরণসভা শেষ পর্যন্ত বারোয়াড়ি মচ্ছবই হয়ে ওঠে।
প্রয়াত কবি নবারুণ ভট্টাচার্য তার স্মৃতিচারণে বলছেন : ‘যে পিতা সন্তানের লাশ…..’ এক ভদ্রলোকের সঙ্গে প্রায়ই আমার বাসে দেখা হয়। অনেক সময় আমরা একসাথে ফিরি।শ্যী কলোনিতে যে পাঁচটি ছেলেকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে কুপিয়ে খুন করা হয়েছিল ইনি তাদের মধ্যে একজনের পিতা।পেশায়–কম্পাউন্ডার।সত্তরের রাজনীতির সন্ত্রাস যে কী তার প্রমাণ শ্রী কলোনির কার্নিভাল। কার্নিভালই বলব কারণ ছেলেগুলি আহত হবার অনেক অনেকক্ষণ পর ছটফট করতে করতে মারা যায় এবং অন্তিম সেই সময়ে তাদের মুখে এক ফোঁটা জলও দিতে দেয়া হয়নি!
লোকে ভিড় করে এই বিভৎস দৃশ্য দেখতে এসেছিল! ওই হতভাগ্য পিতা কাজ করতেন পুলিশ মর্গে।তিনি শহরতলী থেকে আনা পাঁচটি ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহের মধ্যে নিজের ছেলেকে খুঁজে পেয়েছিলেন! এই হত্যাকাণ্ড কিন্তু পুলিশ করেনি। করেছিল ক্ষমতাসীন বৃহত্তম বামপন্থী দল।
এইসব দুঃসহকালেও আশা রাখি, একদিন যুদ্ধটা নিপীড়িত মানুষরাই জিতবে।
………………..
মনজুরুল হক
২৭ জুলাই, ২০১৯