#বুকপকেটে_রাঙতামোড়া_কাঠিলজেন্স_০২
বিজন। শঙ্কর-এর ‘যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ’ উপন্যাসের চরিত্র। নষ্ট টাইপরাইটার সারাই করে। বিজনের বাপটা ম’লে শঙ্কর লেখেন- বিজনের একটা মাইনাস হলো!
“যার একটা ভিক্ষের থালা আছে সেও তা ধোয়-মোছে-যত্নে তুলে রাখে, ঘর পুড়ে গেলেও আধপোড়া খুঁটি থাকে, ছাই থাকে। নদীভাঙ্গা ঘরের কিছুই থাকে না! যে তিনটি মানুষের কথা কইছি, তাদেরও কোনো পিছুটান ছিল না, তা বলে নদীভাঙ্গা তো নয়। তার পরও রাতের ঢাকাগামী গাড়িতে চড়ে বসে। নিশ্চুপ। নিরবতা ভেঙ্গে মইলোবী বলে ওঠে- ছেনোরে মনে আছে? ছেনো!”
‘পেটকাটি চাঁদিয়াল’-এ মনজুরুল হক এভাবে বলতে থাকে…।
সেবার এক বসন্তে বলা নেই কওয়া নেই খুলনা থেকে কালিয়াগামী লঞ্চে চড়ে বসেছিলাম। তারুন্যের বেগই এমন, শুরু হতেই তীব্র গতি…। চেনা পথ। তার পরও ভৈরব, নবগঙ্গার টলটলে ফটিক জল কেটে লঞ্চের বো এগোতে থাকে। সাদা ফ্যানা দুপাশে ভেঙ্গে ভেঙ্গে ছড়িয়ে যেতে থাকে। গাজীরহাট পার হতেই বিকেলটা দ্রুত আসার খবর দেয়। শুনসান। কেবল লঞ্চের একটানা গুমগুম শব্দ। সেই শব্দে মাছরাঙা প্রবল বিরক্তি নিয়ে উড়ে যায়। শব্দ করে না। সান্ধ্য আহ্নিকের আগে হিন্দুবাড়ির কূলবধূরা কাসার থালা বাসন মেজে ধুয়ে বাড়ি ফিরতে গিয়ে সকৌতুকে লঞ্চ দেখে….। ভাবে, হয় উজানে, না হয় ভাটিতে…. একদিকে তার বাপের বাড়ি… লঞ্চটা কি সেদিকে যায়? সাথের মেয়েটা তাড়া দেয়- ‘দেরি অয়ে যাচ্চে রে অবাগী…।’
কখন যে ঘসিবাড়ি গোলা পার হয়েছে খেয়াল নেই। আরও ছোটবেলা ভরা বর্ষায় নদী তখন প্রবল বেগে সব ভাসিয়ে নিয়ে সাগরে ফেলবে, এমন রাগি তার চলন! সে সময় ওই ঘসিবাড়ির গোলায় ঘূর্ণী হতো। আস্ত এক একটা নৌকা পাক দিয়ে মুচড়িয়ে নাকি পানির তলে নিয়ে যেত! কত কত যে মানুষ, নৌকা ডুবেছে…।
কালিয়ার কাছাকাছি আসতেই দেখা মিলল সেই বিখ্যাত অশ্বক্ষুরাকৃতির বিরাট লেক এর মত নদী অংশ। এখানে আর নদী মনে হয় না। ভাঙতে ভাঙতে গোল হয়ে সরোবর হয়ে উঠেছে। মধ্যিখানে একটা ছোট্ট চর পড়ছে। সেই চর ঘুরে রাজকীয় ভঙ্গিতে লঞ্চ কালিয়া ঘাটে ভিড়ল।
একবার সাব্যস্ত হলো আমরা পণ্ডিত রবী শঙ্করের পৈত্রিক বাড়িতে থাকব। বিশাল সাদা রঙের অদ্ভুত সুন্দর বাড়ি। পরে জানা গেল ওখানে থাকার অনুমতি নেই। ‘এই সেই পণ্ডিত রবী শঙ্করের পৈত্রিক বাড়ি’ কথাটা যেন পায়ে শেকল পরিয়ে আটকে রাখল। সম্বিত ফিরে পেলাম হোস্ট বাদশা’র ডাকে-
-চল, কলেজ হোস্টেলে থাহা যাবেনে।
সেও কালিয়ার জমিদার বাড়ি। মূল বাড়িটায় কলেজ হয়েছে। আর গোমস্তা কিংবা দূরের অতিথি এলে যে বাড়িটাতে থাকতে দেয়া হতো সেটিই এখন কলেজ হোস্টেল। দো’তলার সমান এক তলা বাড়ি। সন্ধ্যে হয়েই গিয়েছিল। একটু পরেই খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা হলো। পাটি বিছিয়ে খাওয়া চলছে। ডাল, মাছের ঝোল আর বেরেশতা দিয়ে করা আলু ভর্তা। আমার পাশেই বসেছে দুটো আমাকে একসঙ্গে মেশালে যত মোটা হবে সেরকম এক তাগড়া ছেলে। ফ্যাকাসে কালো। উজ্জল দুটো অদ্ভুত সারল্য মাখা চোখ। আমার ‘পাখির আধার’ খাওয়া দেখে হো হো করে হেসে উঠল।
খাবারের পাট চুকোতে আমরা ছাতে উঠে গেলাম। কুচকুচে কালো শুরকির ঢালাই। মোটা করে গেঁথে তোলা রেলিং। প্রায় গলা অব্দি। ছাতের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আপনাতেই চোখদুটো একশ আশি ডিগ্রি ঘুরে এসে সেই কালোপনা ছেলেটির (আমার থেকে বয়সে ৫/৬ বছরের বড়। ওজনেও মণখানেক বেশী। উচ্চতায় এক ফুটমত) মুখের ওপর পড়ল। সেখানে রাজ্যের কৌতুক।
আমি ধীরে ধীরে রেলিঙের ধারে চলে গেলাম। দূরে খুব বেশী দৃষ্টি যায় না। বৈশাখের ধূসর জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে দূরের মাঠ। এক-দেড়শ বছরের পুরোনো নারকেল গাছগুলো ওপর দিকে এতটাই চিকণ হয়ে গেছে যে কেউ নাকি ভয়ে ওঠে না। ভেঙ্গে যেতে পারে। তাই নারকেল আপনাতেই ঝুনো হয়। পড়ে। গাছগুলো হালকা বাতাসেও দোলে। তারই ফাঁকে ফাঁকে নরোম চাঁদের আলো আলগোছে এসে পড়ছে…. এক অপার্থীব রাত!
‘তেত্রিশ বছর কাটলেও কেউ কথা রাখেনি’…গমগমে কণ্ঠে আবৃত্তি করছে বাদশা। ও তখন স্কুল-কলেজে আবৃত্তি করে সুনাম কুড়িয়েছে। বহুবার শোনা আবৃত্তি আবার নতুন করে শুনলাম। চাঁদের নারিকেল আলো কিংবা পুরোনো জমিদারের কল্পিত স্মৃতিকে কি একটা যেন আছে।
হঠাৎই আমাকে দেখিয়ে বাদশা বলে বসল-
– ‘ও ভালো গান জানে..’।
আর কেউ না, সেই কালো গাট্টাগোট্টা ছেলেটি যাকে আমার অসংস্কৃত মনে হয়েছিল, তার চোখ চকচক করে উঠল-
-‘আপনি গান জানেন? কি গান? আপনারা তো শহুরে মানুষ আমাগে মত পুরোন গান গাবেন না, শোনবেনও না..’
আমি তাকে আশ্বস্ত করি-
‘বলেন না কি গান শুনবেন? আমি পুরোনো গানও জানি’। সে সময় মিউজিক কলেজে গান শিখছি….
-‘আধো রাতে গাতি পারবেন?’
কোনো কথা হলো না মিনিট পাঁচেক। কখন কীভাবে শুরু করেছিলাম জানি না। যখন গানটা শেষ করলাম মনে হলো জীবনের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ পরিবেশে সবচেয়ে সুন্দর করে গেয়েছি। ছেলেটি মন্ত্রমুগ্ধের মত উঠে এলো। জড়িয়ে ধরল। আমি তার বুকের ভেতরের দুপ দুপ শুনছি……।
পরদিন বিকেলে দলবেঁধে নদীর পাড়ে বসে আছি। নদীর সেই অশ্বক্ষুরাকৃতি জায়গা থেকে জোরালো বাতাস বইছে। সিগারেটের ধোঁয়া দেখ পাচ্ছি না। ঠোঁঠ থেকে বেরিয়েই পেছন দিকে মিলিয়ে যাচ্ছে।
হঠাৎই একটি ছেলে প্রস্তাব দিল সাঁতরে নদীর সেই গোল সরোবর মত দেখতে অঞ্চলে যে চর জেগেছে সেখানে যাবো। যেমন ভাবা তেমন বাস্তবায়ন। শহুরে মানুষ বলেই আমাকে জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হলো- আমি সাঁতার জানি। সাঁতার আমি জানি ঠিক। কিন্তু চর্চাহীনতা প্রকাশ করলে মান থাকে না। তাই জোরের সাথেই বললম- ‘জানি না মানে? আমিও গিরামের ছুয়াল!’
সিগারেট, দেশলাই, চানাচুর, কয়েকটা ডাব নিয়ে আমরা ছয়-সাতজন রওনা হলাম। যাবার সময় অস্বাভাবিক কিছু ঘটল না। ঘন্টাখানেক ওই চরে বসে আড্ডা দিয়ে চারিদিক ঘুরে দেখে আমি আপ্লুত। এদিকে ঈষাণ কোণে মেঘ জমেছে কেউ খেয়াল করিনি। করেছে পাড়ে দাঁড়ানো বাদশা। সে আসেনি। গ্রামের থেকেও সাঁতার জানে না! দেখলাম বাদশা প্রবলভাবে একটা রুমাল নাড়ছে…. আর মাঝে মাঝে হাত টেনে ইশারায় ফিরতে বলছে। এবার আমরাও মেঘের চোখরাঙানি টের পেয়েছি। গোছগাছ করে ফিরতে শুরু করেছি। চর আর নদী তীরের মাঝামাঝি আসতেই ঝড় শুরু হলো! বৃষ্টি নেই। শুধুই প্রবল বেগে বাতাস বইছে। তাতেই দুই ফুট মত ঢেউ উঠে গেছে। এইখানটাতে মধুমতি প্রায় আধা মাইল প্রশস্থ। আমি এক মনে সাঁতরে চলেছি….. অনভ্যাসে হাত-পা ঠিক ঠাক সাড়া দিচ্ছে না।
দেখলাম সাথে ছেলেগুলো অনেকটা দূরে চলে গেছে আমাকে ফেলে….পাড় থেকে বাদশার চিৎকার এতক্ষণে এলো…..’হারামজাদা, জোরে হাত চালা… ঝড় আইসে গেছে’…এতক্ষণ অতটা ভয় পাইনি। এবার বাদশার কণ্ঠে কি ছিল জানি না, হঠাৎই আতংকিত হয়ে পড়লাম। হা-পা অবশ হয়ে এলো। ছোট একটা ডুব দিয়ে আবার ভেসে উঠে দেখলাম সাথের সবাই পাড়ে পৌঁছে গেছে। ঠিক এই সময়ে কেন যেন খুব অভিমান হলো! আশ্চর্য, ওরা আমায় ফেলে চলে গেল! পারল? মনে হল আমি আর পারব না। করুণ চোখে বাদশার প্রবল হাত নাড়া দেখছি….হাত চলছে না। পা দুটো কেবল হাঁসের মত এদিক-ওদিক পানি কেটে ভাসিয়ে রেখেছে।
যারা পাড়ে ফিরেছে তারা কি করবে ভেবে দৌড়াদৌড়ি করছে। বাদশা কণ্ঠ শুনছি- ‘এট্টা বাঁশ নিয়ে আয়…’ কেউ বোধ হয় বাঁশ আনতে গেল। আমি আবারও ডুবে কয়েক ফুট নেমে মরে যাবার ভয়ে হাতড়ে-পাচড়ে উঠলাম। মাথাটা ভাসিয়ে রেখেছি। বুঝতে পারছি আর বেশীক্ষণ পারব না। বাদশাকে দেখছি।চিৎকার করে আমাকে সাহস দিচ্ছে। হটাৎ মা’র মুখটা ভেসে উঠল। মা ছোটবেলা বলত- ‘পানিতে ডুবেই তোর মৃত্যু হবে’! চার বছর বয়সে ডুবে গিয়ে বেঁচে আসার পর মা বলেছিল। আমি শেষ বার বাদশাকে কি যেন বলতে চাইলাম। কথাটা ফুটল না। এবার আমি হাল ছেড়ে দিলাম। আর ভেসে থাকতে পারছি না। কে যেন নিচে থেকে পা ধরে টানছে এমন মনে হল! শেষবার বাদশাকে ডাকতে গেলাম…
হঠাৎ দেখলাম পাড় থেকে কে যেন ঝাঁপ দিল। ও কি আমাকে তুলে নিতে আসছে? এটা ভেবে সারা শরীর কেঁপে উঠল। মনে হল- বাঁচব তাহলে? এবার শরীরের সব শক্তি দিয়ে ভেসা থাকার চেষ্টা করলাম। কিন্তু পারছি না। আরও একটু পরে দেখলাম ঝাঁপ দিয়ে সাঁতরে আসছে সেই কালোপনা হাট্টাগোট্টা ছেলেটা! দুপাশে পানি কেটে একটা ছোট্ট নৌকার মত আসছে…পাড় থেকে অনেক মানুষ তাকে উৎসাহ দিচ্ছে….বাঁচার আনন্দে আমার চোখ ফেটে জল নামছে..আর একটু পরেই সে আমাকে তুলে নিয়ে যাবে….কিন্তু আসে না কেন? এত দেরি হচ্ছে কেন…শেষবার দেখলাম কালো একটা দৈত্যের মত কি যেন প্রচণ্ড গতি আসছে… আমি মুহূতের জন্য জ্ঞান হারালাম। ডুবে যাবার আগে কানে বাজতে লাগল- ‘পানিতে ডুবেই তো মৃত্যু হবে’! নদীর তলায় মাটিতে পা ছোঁয়ানোর আগে মাথা ব্যথা করে উঠল! প্রচণ্ড মাথাব্যথা।খানিক পর ভুস করে ভেসে উঠলাম। ছেলেটি আমার মাথার চুল ধরে টেনে তুলেছে। পেট ভরা পানি। ও কোনো কথা বলল না। চকিতে পাক খেয়ে ঘুরে উপুড় হয়ে গেল। এবার বলল
-‘গলা জড়ায় ধরো, পারবা না’? আপনি থেকে তুমিতে নেমে গেছে!
আমি কিছুই বলতে পারলাম না। তবে গলাটা জড়িয়ে ধরতে পারলাম। ওভাবেই একটা বড় মানুষের পিঠে ভাসতে ভাসতে আর একটা ছোট মানুষ তীরে উঠে এলো। পেটে চাপ দিয়ে, মাথায় তুলে ঝাঁকি দিয়ে পানি বের করে দিল। শত শত মানুষ জমে গেছে। সূর্যও ডুবে গেছে। ওরা হেঁটে আর আমাকে রিকসায় করে হোস্টেলে নেওয়া হলো। সবাই মিলে পিঠ চাপড়ে দিচ্ছিল সেই কালো মানিককে। আমি শুধু একবার বললাম- ‘তুমি না থাকলে আজই আমার সলীল সমাধি হতো’….প্রায় ধমকের সুরে আমাকে থামিয়ে বলল- ‘তালি রাত্তির বেলা অমন সুন্দর গান গাবিনি কিডা’?
আমার আর কখনই সেই ছেলেটির খোঁজ নেওয়া হয়নি। আচ্ছা সে কি বেঁচে আছে? কালিয়াতেই থাকে? তার ছেলে-মেয়ে বা নাতি-নাতনিকে কোলে নিয়ে কি নদীর পাড়ে আসলে সেই সেদিনের কথা মনে পড়ে? ও কি তাদের গল্প শোনায়?
একদিন একটা ছেলে এসেছিল এই জনপদে। গান গাইত। আধো রাতে যদি ঘুম ভেঙ্গে যায়…. মনে পড়ে মোরে প্রিয়… চাঁদ হয়ে রবো আকাশের গায়ে… বাতায়ন খুলে দিও…..।।
৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯