ঠিক এই মুহূর্তে কুর্দি জনগোষ্ঠির উপর তুর্কি প্রেসিডেন্ট বর্বরোচিত হামলা করছেঃ
সিরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত কুর্দি যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান শুরু করেছে তুরস্ক। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ওই অঞ্চল থেকে মার্কিন সেনাদের প্রত্যাহার করে নেয়ার পরপরই এই অভিযান শুরু হয়েছে। তুর্কি প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান গত বুধবার সগৌরবে এই অভিযানের ঘোষণা দিয়েছেন। যাকে বাংলাদেশে ইসলামের ‘খিদমতগার’ ভেবে গব্ব করা হয়!
কুর্দ অবস্থানগুলোর উপর বিমান হামলা চালানো হচ্ছে। পুরো অঞ্চলজুড়ে তীব্র আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। অঞ্চলটি থেকে কুর্দি মিলিশিয়ামুক্ত করার কথা জানিয়েছেন এরদোগান। তিনি বলেছেন, সেখান থেকে কুর্দি মিলিশিয়াদের দূর করে সেটিকে ‘মুক্ত অঞ্চল’ করতে এই অভিযান শুরু করা হয়েছে। কুর্দি নেতৃত্বাধীন জোট বাহিনী সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফোর্সেস (এসডিএফ) জানিয়েছে, তুর্কি যুদ্ধবিমানের হামলার শিকার হয়েছে বেসামরিকরাও।
পরম্পরাঃ
কিছুদিন আগে শলা পরামর্শ করে ট্রাম্প এই অঞ্চল থেকে মার্কিন বাহিনী প্রত্যাহার করে নেয়, এবং এর পর পরই ট্রাম্পের স্যাঙাত এরদোগান হামলা শুরু করে।
সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে আইএসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রবাহিনী হচ্ছে কুর্দি মিলিশিয়ারা। সেখানে কয়েক হাজার আইএস সদস্য ও তাদের আত্মীয়-স্বজনদের কারাগার দেখাশোনা করে থাকে কুর্দিরা। অঞ্চলটির অনেকাংশের নিয়ন্ত্রণই তাদের দখলে।
স্ট্রাটিজিক্যাল ফেনোমেনাঃ
সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে সক্রিয় কুর্দি নেতৃত্বাধীন বাহিনীগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, কুর্দিশ পিপলস প্রটেকশন ইউনিট (ওয়াইপিজি)। দলটিকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে বিবেচনা করে তুরস্ক। তুরস্কের সাম্প্রতিক এই অভিযান নিয়ে ইতোমধ্যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসঙ্ঘ, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও অন্যান্য বিশ্ব শক্তিগুলো।
এতদিন পর এসে ওয়াইপিজে বুঝতে পেরেছে ‘আমেরিকা যার মিত্র তার আর শত্রুর দরকার করে না’।
আইএসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ওয়াইপিজি মার্কিন বাহিনীর ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে পরিচিত ছিল। এভাবে সেনা সরিয়ে নিয়ে ট্রাম্প মিত্রদের ‘পেছন থেকে ছুরি মেরেছেন’ বলে তারা এখন অভিযোগ করছেন।
তামাশার শেষ নেই! সমালোচনার পরে ট্রাম্প বলেছেন- ‘সীমা ছাড়ালে’ তিনি তুরস্কের অর্থনীতিকে গুঁড়িয়ে দেবেন। ব্যাডা একখান!
এদিকে কুর্দি গেরিলা গোষ্ঠী ওয়াইপিজির কমান্ডার আবদি বলেছেন, সম্ভাব্য তুর্কি হামলা প্রতিহত করার লক্ষ্যে অনেকগুলো পথ খোলা রেখেছে তার বাহিনী, এর একটি পথ হচ্ছে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ সরকারের সাথে সহযোগিতা করা। খেলঅ শুরু হলো…..
ঘটনা প্রবাহঃ
এরই মধ্যে এরদোগান ‘পিতা’ যখন কুর্দি গেরিলা নির্মূলে হামলা করেছে, ‘পুত্র’ আইএস তখন সিরিয়ার উত্তর পূর্বাঞ্চলে তুরস্কের বিমান ও মর্টার হামলার মধ্যেই কুর্দি নিয়ন্ত্রিত শহর কামিশলিতে গাড়িবোমা হামলা চালিয়েছে।
গত সপ্তাহের মঙ্গলবার থেকে আঙ্কারার ‘অপারেশন পিস স্প্রিং’ শুরুর পর ওই অঞ্চলে এটিই আইএসের প্রথম হামলা।
জঙ্গিগোষ্ঠীটির ‘খিলাফত’ ধ্বসিয়ে দেয়া কুর্দি নেতৃত্বাধীন সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সের (এসডিএফ) হাতেই সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের পর দেশটির সবচেয়ে বড় অংশের নিয়ন্ত্রণ ছিল।
এদিকে শুক্রবার তুর্কি অবস্থান থেকে কোবানের মার্কিন বাহিনীর ওপর গোলাবর্ষণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে পেন্টাগন। ওই হামলায় মার্কিন বাহিনীর কেউ হতাহত হয়নি বলেও নিশ্চিত করেছে তারা। বেশ একটা মজমা মজমা ব্যাপার!
তুরস্কের অভিযানের বিরোধিতা করে চলতি সপ্তাহেই একটি বৈঠকে বসছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। তারা যে কোনোভাবেও তুরষ্কের বিপক্ষে যাবে না সেটা বুঝতে ট্রাম্প হওয়া লাগে না। কেন ব্যবস্থা নেবে না? কারণ তার আগেই এরদোগান হুমকি দিয়ে বসেছেন।
‘আঙ্কারার বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হলে তুরস্কে থাকা সিরীয় শরণার্থীদের ইউরোপে ঢুকিয়ে দেয়া হবে’!
এমন সর্বব্যাপী হামলার মধ্যেও বীরোচিত লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে কুর্দ গেরিলারা। তারা ৭৫ তুর্কি সেনাকে হত্যার দাবি করেছে। এসডিএফ রোববার দাবি করেছে, রাস আল আইন শহরে তাদের সঙ্গে লড়াইয়ে ৭৫ তুর্কি সেনা নিহত ও ৭ ট্যাংক ধ্বংস হয়েছে। এছাড়া আহত হয়েছে ১৯ তুর্কি সেনা।
এদিকে, তুর্কি সেনাবাহিনী তাদের সমর্থিত গেরিলাদের সহযোগিতায় নতুন নতুন এলাকা নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার জন্য তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে বলে দাবি করেছে। এটা আর এক ঘাটালা!
আইএস সিরিয়ায় কী করছে:
কামিশলি এবং হাসাকেহ শহরে দুইটি গাড়ি বোমা বিস্ফোরণের পর কুর্দিদের পক্ষ থেকে এরকম মন্তব্য এলো। ঐ দু’টি গাড়ি বোমা হামলার দায় স্বীকার করেছে আইএস।
শুক্রবার তুরস্কের হামলা চলাকালীন কামিশলির একটি কারাগার থেকে পাঁচজন আইএস সদস্যও পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় বলে এসডিএফ জানিয়েছে।
শনিবার সিরিয়ায় নতুন অভিযান শুরু করার ঘোষণা দিয়েছে আইএস।
তারা বলেছে, কুর্দি নিয়ন্ত্রিত কারাগারে আইএস-এর সদস্যদের বন্দি রাখার প্রতিশোধ নিতে তারা এই নতুন অভিযান শুরু করবে।
এসডিএফ বলেছে তারা সাতটি কারাগারে ১২ হাজারের বেশি সন্দেহভাজন আইএস জঙ্গিকে আটকে রেখেছে এবং তাদের মধ্যে অন্তত চার হাজার বিদেশি নাগরিক।
মূল সমস্যা কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি বা পার্তিয়া কারকেরেন কুর্দিস্তান (কুর্দি ভাষায়: Partiya Karkerên Kurdistan, ইংরেজি ভাষায়: Kurdistan Workers’ Party; পিকেকে, কাদেক, কংগ্রা-গেল বা কেজিকে নামেও পরিচিত) একটি কুর্দিশ সামরিক সংস্থা যা ১৯৭০-এর দশকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এদের রাজনৈতিক আদর্শ মার্কসবাদ-লেনিনবাদ এবং কোনো কোনো স্থানে মাওবাদ।
এই পার্টি ছাড়াও আরও প্রায় ৩২ টা পার্টি আছে কুর্দদের। এই পার্টিসমূহের প্রায় সকলেই স্বাধীনতার জন্য লড়ছে।
কুর্দিস্তান হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রবিহীন জাতির আবাসভূমি। মধ্যপ্রাচ্যে আরব, তুর্কি এবং ফারসিদের পরেই কুর্দিরা চতুর্থ বৃহৎ জাতিগোষ্ঠী। তুরস্ক, ইরাক, ইরান, সিরিয়া এবং আর্মেনিয়ার ২ থেকে ৩ লক্ষ বর্গ কিলোমিটারের বিশাল এলাকা জুড়ে আছে কুর্দিস্তান। এর অধিবাসীরা কুর্দি। এসব এলাকায় প্রায় আড়াই থেকে তিন কোটি কুর্দি বসবাস করে। এছাড়া কুর্দিস্থানের বাইরেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আরো কয়েক লক্ষ কুর্দি বসবাস করে।
পাশাপাশি পাঁচটি দেশ জুড়ে বিস্তৃত হলেও ধর্মীয়, ভাষাগত এবং সংস্কৃতিগত দিক থেকে কুর্দিরা মূলত একই জাতি। কুর্দিরা অধিকাংশই সুন্নী মুসলমান, তবে তারা আরব না। তাদের ভাষা কুর্দি ভাষা, আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসে কুর্দিরা অন্যতম বঞ্চিত এবং নির্যাতিত জাতিগোষ্ঠী। দীর্ঘদিন ধরেই তারা তাদের অধিকারের জন্য আন্দোলন করে আসছে। ফিলিস্তিনের প্রতি সারা বিশ্বের যে মমত্ব আছে কুর্দিদের প্রতি তেমন নেই, কারণ কুর্দিদের সংগ্রামকে পশ্চিমা মিডিয়া কখনই প্রচারের আনেনি। এবং ধামা ধরা চরিত্রের পূর্বের তথা এশিয়ার মিডিয়াও এ নিয়ে কখনও উৎসাহ দেখায়নি। বাংলাদেশে কুর্দিদের নিয়ে আলোচনাই শুরু হয়েছে আইএস এর ‘খিলাফত’ জজবার পর থেকে। এই কুর্দিরাই সবার আগে আইএস-এর বিরোধীতা করেছিল। এখনও করে চলেছে।
ঐতিহাসিক পটভূমি
কুর্দিরা শত শত বছর ধরেই সিরিয়া এবং মেসোপটেমিয়ার সমতল এবং পাহাড়ি ভূমিতে বসবাস করে আসছে। আধুনিক তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্বে, সিরিয়ার উত্তর-পূর্বে, ইরাকের উত্তরে, ইরানের উত্তর-পশ্চিমে এবং আর্মেনিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমে এদের বসবাস। এরা মূলত বেদুইন জাতি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর ১৯২০ সালে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো তুরস্কের সাথে সেভরা চুক্তির উদ্যোগ গ্রহণ করে, যেখানে কুর্দিদেরকে গণভোটের মাধ্যমে স্বাধীন কুর্দিস্তান প্রতিষ্ঠার সুযোগ দেওয়ার প্রস্তাব রাখা হয়েছিল। কিন্তু নব প্রতিষ্ঠিত তুরস্ক প্রজাতন্ত্র সে সময় ঐ চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানায়।
দীর্ঘ টানাপোড়েনের পর ১৯২৩ সালে তুরস্ক এবং পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে লুসান চুক্তি নামে নতুন একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি অনুসারে তুরস্ককে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, কিন্তু এতে কুর্দিদের গণভোটের প্রতিশ্রুতিটি বাতিল করা হয়। ফলে চাপা পড়ে যায় কুর্দিদের স্বাধীনতা বা স্বায়ত্ত্বশাসনের স্বপ্ন এবং শুরু হয় এক দীর্ঘস্থায়ী সংকট। ব্রিটিশ এবং ফরাসিরা বৃহৎ কুর্দিস্তান এলাকাকে ইতোপূর্বে স্বাক্ষরিত সাইকস-পিকো চুক্তির মাধ্যমে সৃষ্টি একাধিক রাষ্ট্রের মধ্যে ভাগাভাগি করে, তাদের মধ্যে কৃত্রিম সীমারেখা টেনে দেয়।
বাংলাদেশ সরকার এখন পর্যন্ত এই কাপুরুষোচিত জঘন্য হামলার নিন্দা করেনি। প্রোটোকলমতে বাংলাদেশ এরদোগান তথা তুরষ্কের পক্ষে থাকবে, যেমন নীরব থেকেছে ইয়েমেনে মানবতার চরম লঙ্ঘনকারী সৌদি জোটের নগ্ন হামলার বিষয়ে!
আমরা সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে এরদোগানের হামলার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। বিশ্বের নিপীড়িত জাতি গোষ্ঠি কুর্দিদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সমর্থন জানাচ্ছি, সহমর্মীতা প্রকাশ করছি।
………………….
মনজুরুল হক
১৪ অক্টোবর, ২০১৯