২০০৪ সালে জামাতের প্রেসক্রিপশনে বিএনপি যখন র্যাপব গঠন করে তখন প্রায় ৯৯ ভাগ সাংবাদিক, সুশীল প্যারাসাইট মধ্যবিত্ত সন্তোষ প্রকাশ করেছিল। তাদের মনবাঞ্ছা ছিল-এবার সব শীর্ষসন্ত্রাসী নির্মূল হবে (সরকার তেমনই বলেছিল) এবং তারা সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে পারবেন। সেসময় আমরা খুব অল্প কিছু মানুষ সাহস করে সংবাদপত্রে লিখেছিলাম—‘মাননীয়গণ আপনারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। এই বাহিনী করা হয়েছে নিষিদ্ধ ঘোষিত কমিউনিস্টদের নিশ্চিহ্ন করতে। তাদের নির্মূল করা শেষ হলে আপনাদের পালা’ এমনকি আব্দুল গাফফার চৌধুরীর মত ‘হেভিওয়েট’রাও মুখে কুলুপ এঁটে ছিলেন। এরপর সকলেই ফলাফল টের পেয়েছেন, এখনও পাচ্ছেন।

❗️

২০০৬ সালে যখন ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’-এর খসড়া হলো, তখনও ওই একই ঘটনা। সুশীলগণের মুখে কুলুপ। ২০১৮ সালে এসে যখন সেই ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ তার ৫৭ নম্বর ধারা নিয়ে যমদূতের মত হাজির হলো, তখনও সাংবাদিককুল বিদেশি দূতাবাসে উৎসবমুখর পরিবেশে মদের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে নিজেদের নিরাপদ ভেবেছেন। মনে মনে সান্তনা খুঁজেছেন—‘ওসব তো রহিমুদ্দি-করিমুদ্দিদের জন্য, আমাদের ভয় কিসের?’

❗️

এই কুখ্যাত আইনে ইতিমধ্যে একাধিক নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে, পঙ্গু হয়েছে, চাকরি গেছে, পরিবার নিয়ে পথে বসেছে, জেলের ভেতর বিনা চিকিৎসায় মারা গেছে। এর পরই কিছু কিছু সাংবাদিক, পত্র-পত্রিকা, সুশীলগণ একটু ট্যাঁ-পো করেছেন, তাও যথাযথ আদব-লেহাজের সাথে।

❗️

আজকে একটা সিম্পল রিপোর্টের কারণে প্রথম আলোর সাংবাদিক শামসুজ্জামানকে গ্রেপ্তার করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় জামিন দেয়া হয়নি। যে সংবাদ প্রকাশের দায়ে সাংবাদিক শামসুজ্জামানের বিরুদ্ধে যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয়েছে সেটা গ্রহণযোগ্য নয়, কারণ ওই বক্তব্য প্রায় সকল দরিদ্র মানুষের। তারা বলতে পারছেন না বা বলতে দেয়া হচ্ছে না কিংবা বলার প্লাটফর্ম নেই। ওই বক্তব্য স্বাধীনতা দিবসে ছাপার কারণে স্বাধীনতাকে অস্বীকার করা হয় না, কারণ ‘কী পাওয়ার জন্য যুদ্ধ করলাম, আর কী পাইলাম’ এমন খেদোক্তি লাখো মানুষ করে।

❗️

তারপরও ওই নিউজের জন্য রাষ্ট্রীয় সংস্থা ‘বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল’ আছে। সেখানে সাংবাদিকতার নীতি বিরোধী কোন সংবাদ প্রকাশ করলে তারা বিচার করবে। তার জন্য ফৌজদারি আদালতে বিচারের জন্য মামলা এবং তুলে নিয়ে গ্রেপ্তার দেখানো হতে পারে না।

❗️

‘ক্রসফায়ার’-এর মত এই ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ও জুলুমবাজীর একটা টুলস। এটা দিয়ে প্রতিবাদী মানুষকে বিচারের আগেই জেলে আটকে রাখা, জামিন না দিয়ে বিচারের মাধ্যমে দোষী প্রমাণিত হওয়ার আগেই সাজা ভোগ করানো যায়! এই ‘টুলস’-এর অন্যতম বৈশিষ্ট-গ্রেপ্তার করার পর জানাজানি না হলে এক ব্যবস্থা, আর জানাজানি হলে গড়ে সকল এজেন্সির অস্বীকার করা। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার আগেই অভিযুক্তকে জেলে আটক রেখে পরে বিচারে নির্দোষ প্রমাণিত হলেও অভিযুক্ত ব্যক্তির স্বস্তি নেই, কারণ ততদিনে তার সামাজিক, অর্থনৈতিক, শারীরিক, মানসিক ক্ষতি হয়ে যায়। যার ক্ষতিপুরণ রাষ্ট্র বা তার পোষক প্রতিষ্টান দেয় না। বিচারে অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার আগ পর্যন্ত কাউকে জেলে আটকে রাখা জঘন্যতম জুলুম কথাটা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। এমনকি অভিযুক্তকে ‘আসামী’ বলারও সুযোগ নেই, অথচ এদেশে তাই করা হয় বছরের পর বছর ধরে।

❗️

অপছন্দের ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলার আগেই গ্রেপ্তার (পড়ুন তুলে নেওয়া), প্রবল চাপে জ্ঞিাসাবাদ, গ্রেপ্তার নিয়ে লুকোচুরির ভেতর রাত দুপুরে মামলা এবং ২৪ ঘন্টা বা তারও বেশি সময় পরে আদালতে তোলা প্রায় ‘রেগুলেশন’ হয়ে উঠেছে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে। কয়েকদিন আগেই ঠিক এভাবেই নওগাঁর ভূমি দপ্তরের কর্মচারী সুলতানা জেসমিনকে মামলার আগেই গ্রেপ্তার করেছিল র্যাব। পরে জানাল—‘ জিজ্ঞাসাবাদের সময় তার মৃত্যু হয়েছে! মৃত্যু হয়েছে স্ট্রোকে!

❗️

পত্র-পত্রিকার খবরে জানা গেছে একজন যুগ্ম সচিবের দায়েরকৃত অভিযোগে সুলতানাকে গ্রেপ্তার করেছিল র্যাব। সেই যুগ্ম সচিব এও বলছেন—’আমার উপস্থিতিতেই র্যাব তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে’! এখন এখানে আদালত কী করবে? এই কেসের তদন্ত, তলব, পুনঃতদন্ত শেষে কী দাঁড়াবে সেটা আমরা জানি না। হয়ত কোনোদিন জানতেও পারব না।

❗️

সাংবাদিক শামসুজ্জামানের গ্রেপ্তারের পর প্রথম আলো’র সম্পাদক মতিউর রহমানের বিরুদ্ধেও ডিএসএ আইনে মামলা হয়েছে। এসব নিয়ে সম্পাদকদের সংগঠন এডিটরস গিল্ড উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। আরও কয়েকটি পত্র-পত্রিকা উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। অবাক ব্যাপার হলো এই ঘটনা নিয়ে সাংবাদিক মহলে যতটা তোলপাড় হওয়ার বাস্তবতা ছিল তা হয়নি! এক শওকত হোসেন মাসুম ছাড়া প্রথম আলোর আর কারও পোস্ট দেখিনি সামাজিক মাধ্যমে (হতে পারে আমার লিস্টে ওই হাউসের লোকজন নেই বা কম)। যত প্রতিবাদ, নিন্দা আর মুক্তি দাবী করেছেন সাধারণ অনলাইন ব্যবহারকারীরা। ঢাকার শিল্প-সাহিত্য-কাব্য-প্রতিভা মহলে এই হাউসের তালেবরাই সংখ্যাগুরু। অথচ তাদের মুখে কুলুপ! আঙ্গুল পক্ষাঘাতগ্রস্থ!

❗️

ঠিক এই কারণে বিখ্যাত কবি মার্টিন নেমলারের কবিতাটি যুগে যুগে প্রাসঙ্গিক।

“ওরা প্রথমে যখন কমিউনিস্টদের ধরে নিয়ে যেতে এলো,

আমি কোন কথা বলিনি,

কারণ আমি কমিউনিস্ট নই।

তারপর ওরা যখন ট্রেড ইউনিয়নের লোকগুলোকে ধরে নিয়ে গেল,

আমি নীরব ছিলাম,

কারণ আমি শ্রমিক নই।

তারপর ওরা যখন ফিরে এলো ইহুদিদের ধরে নিয়ে যেতে,

আমি তখনও চুপ করে ছিলাম,

কারণ আমি ইহুদি নই।

ওরা আবারও আসল ক্যাথলিকদের ধরে নিয়ে যেতে,

আমি টু শব্দটিও উচ্চারণ করিনি,

কারণ আমি ক্যাথলিক নই।

শেষবার ওরা ফিরে এলো আমাকে ধরে নিয়ে যেতে,

আমার পক্ষে কেউ কোন কথা বলল না,

কারণ, কথা বলার মত তখন আর কেউ বেঁচে নেই।”

……………………

মনজুরুল হক

৩০ মার্চ, ২০২৩

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান