মহান মে-দিবসের শপথ হোক শৃঙ্খলমুক্তির

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত বাংলাদেশেও ‘মে দিবস’ পালনের যৌক্তিকতা নেই! এ কোনো ক্ষোভের কথা নয়, নয় কোনো আক্ষেপ। তিক্ত বাস্তবতা। অগাস্ট স্পীজসহ ১৮ জন শ্রমিকের আত্মাহূতির বিনিময়ে আট ঘণ্টা কাজের অধিকার পাওয়ার পর পেরিয়ে গেছে একশ সাইত্রিশ বছর। সেই ১৮৮৬ সালের পয়লা মে শিকাগোর হে মার্কেটের শ্রমিকদের জীবনের মূল্যে যে আট ঘণ্টা শ্রমের দাবি তা আজও বিশ্বের অধিকাংশ দেশে বাস্তবায়ন হয়নি। আজও খোদ মে-দিবসের ‘আতুড়ঘর’ যুক্তরাষ্ট্রে এদিন সরকারি ছুটি নেই! আর বাংলাদেশে ঘটা করে দিবসটি পালিত হয় সরকারি শ্রমিক দলের আনন্দ-নৃত্য সমবিহারে।

🔴

আপামর বাঙালির জীবনে মে দিবস নিয়ে তেমন কোনো উচ্ছ্বাস নেই। ওই দিন সরকারি ছুটি থাকে বলে মধ্যবিত্ত বাঙালিরা বউ বাচ্চা নিয়ে একটু ঘুরতে টুরতে বেরোয়। এদিন যে বিশ্বের মেহনতি মানুষের বিজয়ী হওয়ার দিন। এদিনের লক্ষ্য এবং আদর্শ যে শ্রমিকের ৮ ঘন্টা শ্রম বাস্তবায়ন করা, সেসব নিয়ে বাংলাদেশের বাম দলগুলোর শক্ত কোনো লক্ষ্য নেই।

🔴

দিনটিতে সরকার প্রধান, মন্ত্রীবর্গ, রাষ্ট্র প্রধান, প্রধান বিরোধী দল, ছাও পোনা বিরোধী বা সহমতের দলগুলো বাণী দেয়। খুব সকালে পরিবহন শ্রমিকরা মাথায় লাল পট্টি বেঁধে বিনা ভাড়ার বাসে-ট্রাকে মিছিল করে হৈহুল্লোড় করে। নেতা-নেত্রীরা এখানে ওখানে ভাষণ-টাষণ দেয়। মিডিয়ায় দিনভর শ্রমিক দরদি কাসুন্দি বেটে দর্শককে খাওয়ানো হয়। রাতে তাবড় তাবড় সব বিদ্ব্যৎজনেরা স্টুপিড বাক্সো গরম করে ফেলেন।পত্রিকাঅলারা প্রথম পাতার কোণায় এক ইট ভাঙ্গা নারী শ্রমিকের ছবি ছেপে ক্যাপশন লিখবে…..‘আজ ঐতিহাসিক মে দিবস’…‘আজও কি শ্রমিকের মুক্তি এসেছে?’ এবং রাত ফুরোলেই ওই মহান মে দিবসের যবনিকা।

🔴

কিন্তু, যে শিশু শ্রমিকটি বাসা বাড়িতে অগুনতি ঘণ্টা ধরে গাধার খাটনি খেটে চলেছে, খুব ভোরে উঠে যার দিন শুরু, আবার রাতে সবার খাওয়া দাওয়া শেষ হলে যার ঘুমোনোর সময়, তার জন্য কোন আট ঘণ্টার মহান মে দিবস নেই। সে জানেও না আট ঘণ্টা মানে কত ঘণ্টা? ট্যানারির নাড়িভুড়ি বেরিয়ে যাওয়া গন্ধময় পরিবেশে যে শ্রমিকরা কাজ করছে, তাদের সাথে যে শিশু শ্রমিকরা নোংরা ময়লা ঘেটে জীবনের সুকুমার শৈশবকে মাটি চাপা দিচ্ছে, বয়লারের পাশে গনগনে আগুনের পাশে দাঁড়ানো যে শ্রমিকটির মুখ সারাক্ষণই লাল হয়ে জ্বলছে, শহরের বাইরে মায়ের সাথে ইট ভাঙ্গছে যে কচি শিশুটি তার কাছেও মে দিবস কোন গুরুত্ব বহন করে না। সে জানে তার হাতে ধরা হাতুড়ি একটু বেসামাল হলেই আর এক হাতে পড়বে! চিরতরে পঙ্গু হয়ে যাবে।

🔴

খুব সকালে ভেড়ার পালের মত দলবেধে যে নারী শ্রমিকরা কাজে যাওয়ার জন্য রাস্তায় কুঁচি দৌড় দেয়, তারা গার্মেন্ট শ্রমিক।তাদের জীবনে আট ঘণ্টা নামক কোনো ব্যাপার নেই। অধিকাংশ কারখানায় নামমাত্র ওভার টাইমের বিনিময়ে বার এমনকি ষোল ঘন্টা পর্যন্ত শ্রম শুষে নেয়া হয়। সারা ঢাকা শহরে শকুনের মত শ্যেন দৃষ্টি মেলে হাজার হাজার শিশুর দিন শুরু হয়। তারা কাগজ কুড়োয়। এক হাতে পলিথিনের বস্তা আর এক হাতে ক্রমাগত কাগজ কুড়িয়ে চলে। ওদেরও শ্রম দিবস মানে বার থেকে ষোল ঘণ্টা। এই শহরেরসহ গোটা দেশে লাখো শিশু শ্রমিক আছে যারা হোটেল-রেস্তোরায় পেটে-ভাতে কাজ করে। তাদের আট ঘন্টা দূরের কথা, চব্বিশ ঘন্টাই কর্মস্থলে কাটাতে হয়।

🔴

এই মহানগরীতে ঠিক কত লাখ শ্রমিক এবং সেই সব শ্রমিকের কত লাখ অপ্রাপ্ত বয়সের শিশু শ্রমিক তার কোন খতিয়ান মহান রাষ্ট্রের কোন দপ্তরে নেই। ঠিক কত লাখ ‘কাজের মেয়ে’ এই মহানগরীতে শ্রম শোষণের শিকার, কত লাখ নারী-পুরুষ বাসা বাড়িতে যৌন হয়রানির শিকার, কত লাখ অপরিণত বয়সী মেয়ে বাড়ির কর্তা, দারোয়ান, গ্রামের আত্মিয়, ড্রাইভার আর এই টাইপ অফিসিয়াল ধর্ষকের দ্বারা ধর্ষিত তারও কোন অথেনটিক স্ট্যাটাস সরকারের হাতে বা তথাকথিত মানবাধীকার সংগঠনগুলোর কাছে নেই। এদের কেউ তার কর্ম জীবনে আট ঘণ্টা বলে যে একটা শব্দ আছে সেটাই জানেনি। বোঝেনি।

🔴

শ্রম শোষণ বা শ্রম চুরির মত একটি অত্যন্ত জরুরি বিষয় নিয়ে এই রাষ্ট্র, সরকার, বিরোধী দল, ছোট বড় হেন-ত্যান দল এবং বুদ্ধিব্যাপারিদের কোন চিন্তা নেই। এ নিয়ে সংবিধান সংশোধনও হবে না, সংসদে কোনো বিলও পাশ হবে না। অথচ সারা দেশে প্রায় সাড়ে পাঁচ থেকে ছয় কোটি গতরখাটা শ্রমিকের সিংহভাগই শ্রম শোষণের শিকার। সেই অজ পাড়াগাঁ থেকে শুরু করে এই তিলোত্তমা মহানগরীতে বেশুমার সেই শ্রম শোষণ আর শ্রমচুরি চলছে। এদেশে যে কোটি কোটি ক্ষেতমজুর সারা দিনমান শ্রম দিয়ে চলে তারা অফিসিয়ালি শ্রমিক নয়! সরাসরি এই চুরির সাথে জড়িত এ দেশের প্রায় সকল বিত্তবান, মধ্যবিত্ত এবং ক্ষুদে বিত্তের মালিকগণ।

🔴

‘এই দেশে গার্মেন্ট এসে কাজের বুয়া পাওয়া যায় না, তাদের এখন বেজায় দেমাগ, বাসায় কাজের চেয়ে তারা গার্মেন্টে কাজ করে যুৎ পায়’, এই টাইপ ‘হতচ্ছাড়াদের’ কারণে এই মহানগরীর তামাম গৃহবধূ বিরক্ত, রুষ্ঠ! যে মেয়েটি বাসায় কাজ করার বদলে গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে কাজ করে সে মনে করে এখানে বার ঘণ্টা কাজ করলেও সকাল-বিকাল মালকিনের লাথি গুতো নেই। কিন্তু লাথি গুতো যাদের নিত্যসঙ্গি তারা পার পাবে কি করে? গার্মেন্টেও ওদের ছোট ছোট শরীরের ওপর বড় বড় শরীর রাত বিরেতে উঠে পড়ে। ‘না’ করতে পারে না। ‘না’ বললে চাকরি থাকবে না। ওই অপারেটারদের ভেতর থেকেই কোনো কোনো মেয়েকে যারা দেখতে একটু ভালো তাদের ডাক পড়ে মালিকের খাস চেম্বারে। ওই সব মালিকরা বেশ তৃপ্তি সহকারেই বলেন- ‘বাজারের অসুখ বিসুখঅলাদের চেয়ে এরাই ভালো!’

🔴

ওই যে সাড়ে পাঁচ থেকে ছয় কোটি গতরখাটা শ্রমিকের প্রায় এক তৃতীয়াংশই শিশু শ্রমিক। বিশ্বের আর কোথাও বিভিন্ন বিপজ্জনক সেক্টরে এত শিশু শ্রমিককে দিয়ে কাজ করানো হয় না। এখানে হয়, কারণ এখানকার শিল্পপতি থেকে শুরু করে হালের মডার্ণ আইটি স্পেশালিস্ট, টেকনোলজিস্ট, সিভিল ব্যুরোক্র্যাট, মিলিটারি ব্যুরোক্র্যাট, বিদেশে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত নিয়মর্ডানিস্ট, একেবারে হালের তরুণ প্রজন্ম সবাই সেই পিতৃপুরুষের সামন্তবাদে আক্রান্ত। সামন্ত প্রভুদের জুতো মোজা খুলে দেয়ার জন্য, অজুর পানি দেয়ার জন্য, মাথায় ছাতা ধরার জন্য, ভেতর বাড়ি থেকে পানটা সুপারীটা এনে দেয়ার জন্য একটা ‘পিচ্চির’ দরকার হয়। অথচ পুঁজিবাদে সক্ষম এবং স্কিল্ড শ্রমিক একটা এ্যাসেট। পুঁজিবাদ সেই এ্যাসেটকে বাঁচিয়ে রাখে, তাকে দিয়ে আগামী দিনেও যেন কারখানার চাকা চালু রাখা যায়। সে কারণে পুঁজিবাদের চরম উৎকর্ষেও স্কিল্ড শ্রমিকের চাহিদা ফুরোয় না।

🔴

সামন্তপ্রভুর কাছে শ্রমের বিনিময় মূল্য স্রেফ পেটেভাতে! পেট পুরে ভাত দেয়া হয়, এটাই সামন্তবাদের মহান বদান্যতা! আর বছর বছর জিডিপি নিয়ে রেমিট্যান্স নিয়ে ভেরেন্ডাভাজা আমলা-চামচাদের চিৎকার চেচামেচির পরও, লাখ লাখ শ্রমিক বিদেশে কাজ করে কড়কড়ে কারেন্সি নোট কামাই করে আনলেও, আইটি দিয়ে ডিজিটাল সিস্টেমে দেশ ভরিয়ে দেয়ার কেতাবি ঘোষণার পরও এদেশে যথাযথ পুঁজিবাদী সংস্কৃতি গড়ে উঠল না। এই আধা সামন্তবাদী-আধা পুঁজিবাদী জগাখিঁচুড়ি পাশবিক বণিক সমাজে তাই মে দিবস এবং সেই সেই দিবসের প্রতিপাদ্য এটুকুই যে দিনটি শ্রমিকদের দিন!

🔴

মে দিবসের সংক্ষিপ্ত ইতিহাসঃ

অগাস্ট স্পীজসহ ১৮ জন শ্রমিকের আত্মাহূতির বিনিময়ে আট ঘণ্টা কাজের অধিকার পাওয়ার পর পেরিয়ে গেছে একশ ছত্রিশ বছর। সেই ১৮৮৬ সালের পয়লা মে শিকাগোর হে মার্কেটের শ্রমিকদের জীবনের মূল্যে যে আট ঘণ্টা শ্রমের দাবি তা আজও বিশ্বের অধিকাংশ দেশে বাস্তবায়ন হয়নি।

১৮৮৬ সালের ১লা মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটে ৮ ঘন্টা শ্রমদিনের দাবীতে আন্দোলনরত শ্রমিকের ওপর পুলিশ গুলি চালালে ১১ জন শ্রমিক শহীদ হন। এই ঘটনার আগে শ্রমিকদের প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১০ থেকে ১২ ঘন্টা আর সপ্তাহে ৬ দিন শ্রম দিতে হতো। বিপরীতে মজুরী মিলত নগন্য, এবং সেই কম মজুরি দিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করতে হতো তাদের। কোথাও কোথাও তা দাসবৃত্তির পর্যায়ে পড়ত। ১৮৮৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের একদল শ্রমিক দৈনিক ৮ ঘন্টা কাজ করার দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন, এবং তাদের এ দাবী কার্যকর করার জন্য তারা সময় বেঁধে দেন ১৮৮৬ সালের ১লা মে। কিন্তু কারখানা মালিকগণ এ দাবী মেনে নেয়নি। ৪ঠা মে ১৮৮৬ সালে সন্ধ্যাবেলা হালকা বৃষ্টির মধ্যে শিকাগোর হে-মার্কেটে শ্রমিকরা মিছিলের উদ্দেশ্যে জড়ো হন। আগস্ট স্পীজ নামে এক নেতা জড়ো হওয়া শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিচ্ছিলেন। হঠাৎ দূরে দাড়ানো পুলিশ দলের কাছে একটি বোমার বিস্ফোরন ঘটে, এতে এক পুলিশ নিহত হয়। এবং সাথে সাথে পুলিশবাহিনী শ্রমিকদের উপর অতর্কিতে হামলা শুরু করে। হামলায় ঘটনাস্থলেই ১১ জন শ্রমিক শহীদ হন। আবার পুলিশ হত্যা মামলায় আগস্ট স্পীজ সহ আটজনকে অভিযুক্ত করা হয়। এক প্রহসনমূলক বিচারের পর ১৮৮৭ সালের ১১ই নভেম্বর প্রকাশ্যে ৬ জন শ্রমিকের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। লুইস লিং নামে একজন একদিন পূর্বেই কারাভ্যন্তরে আত্মহত্যা করেন, অন্য একজনের পনের বছরের কারাদন্ড হয়। ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে আগস্ট স্পীজ বলেছিলেন, “আজ আমাদের এই নি:শব্দতা, তোমাদের আওয়াজ অপেক্ষা অধিক শক্তিশালী হবে”। শেষ পর্যন্ত শ্রমিকদের “দৈনিক আট ঘন্টা কাজ করার দাবী সরকারিভাবে স্বীকৃতি পায়। আর পহেলা মে বা মে দিবস প্রতিষ্ঠা পায় শ্রমিকদের দাবী আদায়ের দিন হিসেবে।

🔴

বাংলাদেশে গার্মেন্ট চালু হওয়ার পর এটাই সবচেয়ে শ্রমঘন সেক্টর। হাজার পাঁচেক গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে প্রায় ২০-৩০ লাখ শ্রমিক কাজ করে। এটা প্রায় নিয়মের মতই হয়ে গেছে যে, শ্রমিকরা তাদের বেতন ভাতা, বোনাস, ওভারটাইমের দাবিতে কর্মবিরতী করবে, কারখানা গেটের সামনে অবস্থান ধর্মঘট করবে। এক সময় পোশাক শ্রমিকদের জন্য হিংস্রভাবে গড়ে তোলা বিশেষ পুলিশ আসবে, র্যাব-বিডিআর আসবে, বিশেষ বাহিনী আসবে। এবং নির্বিচারে শ্রমিকদের উপর নির্মম নির্যাতন চালাবে। ঘটনাস্থলেই কিছু শ্রমিক মারা যাবে। হাসপাতালে এবং পথে ঘাটে আরো কিছু মারা যাবে। কিছু শ্রমিককে মালিকের পোষা গুণ্ডারা পিটিয়ে হত্যা করবে। কিছু শ্রমিকের লাশ ওই বিশেষ বাহিনী গুম করে দেবে। চূড়ান্ত বিচারে দেখা যাবে দশ-পনের হাজার নাম না জানা শ্রমিকের বিরুদ্ধে অমুক থানায় হত্যা, অগ্নিসংযোগ এবং লুটতরাজের মামলা দেয়া হবে। ওই মামলায় এর পরে যাকে তাকে ধরে আসামি বানিয়ে দেয়া হবে। আর এই শ্রমিক নিধনের নির্লজ্জ খেলাটা প্রকাশ্যে এদেশের বিশেষ বাহিনী মালিক পক্ষের সহায়তায় সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে খেলবে। এবং এটা প্রায় রোজকার নিয়ম।

🔴

এর পরও যদি শ্রমিকরা তাদের দাবি টাবি নিয়ে আরো একটু স্বোচ্চার হতে চায় তাহলে তাদেরকে কারখানার ভেতরে রেখে খুব ঠাণ্ডা মাথায় কারখানায় আগুণ ধরিয়ে দেয়া হবে। জ্যান্ত পুড়ে মরবে ডজন ডজন হতভাগা শ্রমিক। ফায়ার সার্ভিসের লোকেরা দিন শেষে প্রতিবেদন দেবে-‘সর্ট সার্কিট থেকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে থাকতে পারে’! সরকার এবং মালিক পক্ষ তিন বা চার সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি করবে। মোদ্দা কথা হচ্ছে এই সেক্টরে যে হতভাগা শ্রমিকরা কাজ করে তারা নির্ভেজাল দাস। সেই দাসদের যতদিন সম্ভব শ্রম শুষে নিতে হবে। বাড়াবাড়ি করলে স্রেফ পুড়িয়ে মারা হবে। এবং বছরের পর বছর এই ঠাণ্ডা মাথার হত্যাকাণ্ড ঘটে চলেছে বাংলাদেশের গার্মেন্ট সেক্টরে। এ নিয়ে এই দেশের তাবড় তাবড় জ্ঞানীগুণী বুদ্ধিব্যাপারিদের কোনোও মাথা ব্যথা নেই।

🔴

একানব্বই সালে ক্রেমলিনের চার দেয়াল ভেদ করে পুঁজিবাদী দানব বেরিয়ে এসে সমগ্র পৃথিবীকে আবার নতুন করে গ্রাস করে ফেলার পরও এ দিন মস্কোর রেড স্ক্যয়ারে অশতিপর বৃদ্ধ বৃদ্ধারা লাল পতাকা নিয়ে হাজির হবেন। অপসারিত লেনিনের মুর্তির পাদদেশে ক্ষণিক তাকিয়ে থাকবেন। ১৯১৭ সালের পর এই রেড স্ক্যয়ারে মে দিবসে কি কি ঘটত সে সব ধূসর হয়ে যাওয়া স্মৃতি মন্থণ করবেন। তার পরও তারা সারা দিন ওই রেড স্ক্যয়ারে পড়ে থাকবেন। প্যারিসের ল্যূভার স্ক্যয়ারে, স্পেনের রাজ প্রাসাদের বাইরে, বনের ফ্রিডম স্ক্যয়ারে, তিরানার হোক্সা এভেন্যুতে, চীনের তিয়েনআনমেন স্ক্যয়ারে, ভিয়েতনামের হো চি মিন স্ক্যয়ারে, হাভানার চে স্ক্যয়ারে হাজার হাজার শ্রমিক এ দিন সমবেত হবেন না। হয়ত নতুন করে শ্রমিকের মুক্তির শপথও নেবেন না। হয়ত কিছুই করবেন না। হয়ত সারা দিন দাঁড়িয়ে বা বসে সেই সব পুরোনো স্মৃতি হাতড়ে হাতড়ে একরাশ হতাশা বুকে নিয়ে আবার ঘরে ফিরে যাবেন। ইউরোপের দেশে দেশে গত এক দশক ধরে নতুন করে যে বিক্ষোভ দানা বেঁধে পাথরের মত শক্ত হতে শুরু করেছে। সেই পাথরের দৃঢ়তা নিয়ে তারা আরো একটু এগুতে চাইলে হয়ত পুলিশ গুলি ছুড়বে। নতুন একজন অগাস্ট স্পীজ তাদের সামনে এসে না দাঁড়ালেও তারা এই আশায় আবারো বুকের গহিনে বজ্রনিনাদ শুনবে। এক সময় মনের গহিনে ক্ষীণ হলেও সেই আশার সলতে জ্বালিয়ে ঘরে ফিরবে- একদিন এই পৃথিবীটা আমাদের জন্য বাসযোগ্য হয়ে উঠবে। একদিন আমরাই এই পৃথিবী থেকে মানুষে মানুষে শোষণ বঞ্চণা দূর করে বৈরী দয়ামায়হীন পৃথিবীটাকে সব মানুষের জন্য বাসযোগ্য করে তুলব। কেননা একমাত্র শ্রমিকরাই পারে একটি সোনালী আগামীর জন্ম দিতে। সেটা দেখার জন্য কেউ বসে থাকবে নিষ্ক্রিয়ভাবে, আর কেউ সক্রিয় হবে। মাঝামাঝি কোনো রাস্তা নেই। আসলেই নেই।

🔴

আমরা যখন মে-দিবস নিয়ে লুতুপুতু আবেগে নেকু নেকু কুমিরের লেজ খাঁজ কাটা খাঁজ কাটা ধরণের গপ্প্ লিখছি, সেসময় বাংলাদেশের জবাবদিহিহীন ডেসপ্যারেট শাসক শ্রেণি আইন করেই শ্রমিকদের মিছিল-মিটিং-সমাবেশের অধিকার কেড়ে নিতে চাইছে। যে জাপান-কোরিয়াকে ‘জামাই আদর’ দিয়ে একটার পর একটা ইপিজেড তুলে দেওয়া হচ্ছে কমিশন খাওয়ার লোভে, সেই দুটি দেশই ঘোরতর শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়নবিরোধী! কষ্টের কথা হলো এই বদমায়েশি নিয়ে শ্রমিক এবং শ্রমিকদের নাম ভাঙিয়ে করেকম্মে খাওয়া মৌসুমী জনদরদীদের কোনো হেলদোল নেই। এ কারণেই লেখার শুরুতে উল্লেখ করেছি—মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত বাংলাদেশেও ‘মে দিবস’ পালনের যৌক্তিকতা নেই! এ কোনো ক্ষোভের কথা নয়, নয় কোনো আক্ষেপ। তিক্ত বাস্তবতা। মে-দিবসটা এখানে শাসক এবং তার পোষ্য শেণির সকল ডান-বাম-মধ্যবাম-পাতি বামদের ভণ্ডামিপূর্ণ বিলাসিতা মাত্র।

🔴

মনজুরুল হক

১ মে, ২০২৩

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান